সাম্প্রতিক পাহাড় ধসে মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে পার্বত্যাঞ্চলের চার হাজারের বেশি শিশু। অনেকেই গৃহহীন হয়েছে। মা-বাবার মৃত্যুতে শেষ অবলম্বনটুকু হারাতে হয়েছে অনেককে। বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যালয়ে গমন। এখন তারা রয়েছে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি পাচারের ঝুঁকিতে।
পাহাড় ধস-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে যৌথভাবে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ ব্যবস্থাপনা সংস্থা কেয়ার। ওই প্রতিবেদনেই এ আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে।
চলতি বছরের ১৩ জুন চট্টগ্রামসহ পার্বত্য জেলাগুলোয় পাহাড় ধসের ঘটনায় প্রাণ হারান প্রায় ১৬০ জন। এ ঘটনায় ধ্বংস হয়ে গেছে ছয় হাজারের বেশি স্থাপনা। এর মধ্যে বিদ্যালয় রয়েছে ৩৮টি। সবমিলে এ ঘটনায় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৭৯ হাজার ২৩৯ জন। সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন ৩৩ হাজার ৯০৭ জন, যার মধ্যে ৪ হাজার ২৮ জনই শিশু।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও কেয়ারের মূল্যায়ন অনুযায়ী, পাহাড় ধসের সাম্প্রতিক ঘটনাটি দেশের পার্বত্যাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহতম। এতে একদিকে যেমন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যোগাযোগ ও অবকাঠামো। ঝুঁকির মুখে পড়েছে স্থানীয় শিশুনিরাপত্তা, শিক্ষা ও খাদ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থাও।
পাহাড় ধসে শিশুনিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সম্পর্কে মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু সংখ্যক শিশুর ক্ষেত্রে এ সময় পিতৃহীন বা মাতৃহীন অথবা উভয়কেই হারানোর ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া যেসব শিশুর পরিবার গৃহহীন হয়েছে; জীবনযাত্রা ও আবাসন নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যস্ত থাকায় পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের দিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। স্বজন বা অবলম্বন হারানোর শোক ছাড়াও খাদ্য, বাসস্থান, নিরাপত্তা ও জীবিকা নির্বাহের তাগিদে এসব শিশু এক ধরনের মানসিক চাপে রয়েছে। পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ক্লাবগুলোর অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সৃজনশীল কাজকর্মের সুযোগ না থাকায় এসব শিশু এখন ড্রপ আউট, শিশুশ্রম ও পাচারের ঝুঁকিতে রয়েছে।
দেশের জেলাগুলোর মধ্যে সামাজিক উন্নয়ন সূচকে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে পার্বত্যাঞ্চলের জেলাগুলো। এছাড়া অবকাঠামোর অভাব, অনুন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সেবার দুষ্প্রাপ্যতা এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীগুলোর জীবনমান উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীগুলোকে বৃহত্ পরিসরে সেবা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়টি কঠিন করে তুলেছে কর্মসংস্থান ও জন-অংশীদারিত্বের অভাব। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে এ অঞ্চলের সহিংসতা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা গেলেও পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। সবমিলে নানা সংকটে জর্জরিত দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর জনসাধারণের জন্য বেঁচে থাকার বিষয়টিকে আরো কঠিন করে তোলে সাম্প্রতিক পাহাড় ধসের ঘটনা।
পার্বত্যাঞ্চলের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় পাহাড় ধসের প্রভাব পড়েছে ব্যাপক। এখানকার মোট ৩৮টি স্কুল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রাঙ্গামাটিতে আংশিক থেকে শুরু করে ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলের সংখ্যা ৩৬টি। এগুলোর বেশির ভাগেই পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণের অভাব ছিল আগে থেকে। এর ওপর আবার পাহাড় ধসের ঘটনায় নষ্ট হয়েছে আরো বেশকিছু শিক্ষা উপকরণ। জেলায় একেকটি স্কুলের মধ্যে গড় দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। পাহাড়ি রাস্তা পার হয়ে এসব বিদ্যালয়ে যেতে হাঁটতে হয় সমতলের চেয়ে অনেক বেশি। শিশুদের জন্য এ দূরত্ব পার হওয়া বেশ কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা না থাকায় পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীগুলোর শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল আগে থেকেই। বিদ্যালয় ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে বিষয়টিতে সংকটের মাত্রা বেড়েছে। শুধু রাঙ্গামাটি নয়, পার্বত্য সবগুলো জেলায়ই এ চিত্র কমবেশি একই ধরনের। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলে একদিক থেকে যেমন শিশুশিক্ষার হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে; অন্যদিকে বেড়েছে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ ও ড্রপ আউটের হার বৃদ্ধির আশঙ্কা।
পাহাড় ধসে পার্বত্যাঞ্চলের শস্যের পাশাপাশি বসতভিটাসহ বিভিন্ন স্থানে রোপণ করা সবজি ও ফলফলাদির অনেক বাগানই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি দেখা দিয়েছে সুষ্ঠু জীবনযাত্রার শঙ্কা। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিহীনতার দিক থেকেও ব্যাপক ঝুঁকিতে রয়েছে পার্বত্যাঞ্চলের শিশুরা। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে বান্দরবান জেলা সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য অনিরাপত্তার (ক্রনিক ফুড ইনসিকিউরিটি- সিএফআই) মুখে রয়েছে বলে মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানকার ক্ষতিগ্রস্তরা খাদ্যের গ্রহণ মাত্রা ও মানসম্মততা দুদিক থেকেই বেশ পিছিয়ে রয়েছে। ফলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। ধসের আগে মে মাসেই এখানকার ২ হাজার ১৮৬ শিশুর মধ্যে অপুষ্টিজনিত সমস্যা চিহ্নিত করা হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থায় ছিল ১২৯ জন। পাহাড় ধসের পর সৃষ্ট ফসলের ক্ষতি ও খাদ্যের অভাব এবং চড়া মূল্যের কারণে এ অপুষ্টি আরো অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে রাঙ্গামাটির ক্ষতিগ্রস্ত অধিবাসীদের মধ্যে খাদ্যগ্রহণের মাত্রা তুলনামূলক ভালো হলেও এর মানসম্মততা কম। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জেলার শিশুদের মধ্যে ৭০ শতাংশই প্রয়োজনীয় মানসম্মত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার পাচ্ছে না। দুর্যোগ-পরবর্তী ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব ও খাদ্যের প্রাপ্যতা কমে যাওয়া পুষ্টিহীনতার এ সমস্যাকে আরো মারাত্মক করে তুলতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড় ধসের পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্যাঞ্চলে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা মোকাবেলার মূল দায়িত্ব সরকারেরই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, শুধু পাহাড় ধস নয়; যেকোনো দুর্যোগেই শিশুরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার ফলে বাধ্য হয়েই বিদ্যালয় ছাড়তে হয় তাদের। এ সময় বিভিন্ন ধরনের উপার্জনমূলক কাজেও জড়িয়ে পড়ে তারা। সরকারের উচিত, এসব শিশুকে বিশেষ বৃত্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা ও খাদ্যসহ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে এগিয়ে আসা।