যেভাবে লুট হয় ব্যাংকের টাকা

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

 

bd-pratidin-01-2017-07-13-01
পরিচালকরা আত্মীয়-স্বজনের নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না, নামসর্বস্ব কোম্পানিকে কমিশনের বিনিময়ে ঋণ, জাল দলিল ভুয়া এফডিআর মর্টগেজ দেখানো হয়
শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত নয়, বেসরকারি ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়ে তা পুরোপুরি মেরে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ওই টাকা আত্মসাৎ করছেন ব্যাংকের পরিচালকরা। এমন কি ১৮ বছর বয়সী তরুণী থেকে শুরু করে পরিচালকের কাজের লোক, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শির নামে ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করছেন না। বছরের পর বছর অনাদায়ী দেখিয়ে পরবর্তীতে তা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া ভুয়া কাগজপত্র, জাল দলিল, ভুয়া এফডিআর মর্টগেজ হিসেবে দেখিয়ে যাচাই-বাছাই না করে আবেদনকারীদের বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ঋণের বিপরীতে রাখা জামানতের সম্পত্তিতে সাইনবোর্ড লাগানোর নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এভাবেই বিসমিল্লাহ গ্রুপ এবং হলমার্কের মতো ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও এ ধরনের অস্বাভাবিক ঋণ দেওয়ার বহু ঘটনা ঘটেছে।

জানা গেছে, নব্য ব্যবসায়ী, কোনো ধরনের বিনিয়োগ ছাড়া রাতারাতি উদ্যোক্তা বনে যাওয়া এবং নামসর্বস্ব গ্রুপ অব কোম্পানিজের নামেও দেদার ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। যার বেশির ভাগই পরর্তীতে অনাদায়ী থেকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ঋণ নেওয়ার সময় ঋণের আবেদনকারীরা ব্যাংকের পরিচালক এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের কমিশন দিয়ে তা বোর্ডে অনুমোদন করিয়ে নিচ্ছেন। ফলে ওই ঋণ পরিশোধে তেমন কোনো তাগিদ দেখা যায় না ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির অভাব, সময় মতো অডিট না হওয়া এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ অডিট ঠিকমতো না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এতে দেশের পুরো ব্যাংক খাত মারাত্মক ঝুঁকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এসব লুটপাটের ঘটনায় দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের অন্তত পাঁচটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তাতেও থামছে না ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা লুটপাট।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঋণখেলাপিদের একটা বড় অংশই আছে, যাদের ঋণ দেওয়ার সময় সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়নি। ঋণগ্রহীতাদের সম্পদ মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ম মানা হয়নি। এর ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর যারা শীর্ষ খেলাপি তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। এদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা ব্যাংকের পরিচালক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে থাকেন। ফলে এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। আর ব্যাংকগুলোর নিজেদের তদারকি ব্যবস্থাও শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কাজকর্মে পরিচালকদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভুয়া দলিল, ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পর তা পরিশোধ করছেন না গ্রাহক। অনেক ক্ষেত্রে ঋণ নেওয়ার জন্য ভুয়া টিআইএন নম্বরও খোলা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংককে দেওয়া কাগজপত্রের ঠিকানা অনুযায়ী গ্রাহকের খোঁজ পায় না ব্যাংক। খোঁজ পেলেও আইনি জটিলতায় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কারও কারও বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করলেও তা ঝুলে থাকছে বছরের পর বছর। কিন্তু এর কোনো সমাধান হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে ঋণের কিস্তি না পেয়ে নির্দিষ্ট সময় পর ওই সব ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত করছে। ফলে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। জানা গেছে, প্রথম সারির একটি বেসরকারি ব্যাংকে ৩৪৮ কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারি ও আত্মসাতের ঘটনায় ওই ব্যাংকের এমডি, ডিএমডিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দুদকের মামলায় আসামি করা হয়েছে। ঈদের পর থেকে তারা আর অফিসেও আসছেন না। এতে ব্যাংকটির সার্বিক কার্যক্রমে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই ব্যাংকটিতে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে গত মে মাসে পর্যবেক্ষক বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির ঋণশৃঙ্খলাও ভেঙে পড়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক তদন্তে উঠে এসেছে। ব্যাংকটির ঋণ যাচ্ছে নির্দিষ্ট কয়েকটি গ্রুপের কাছে, যা আদায়ও হচ্ছে না। এর পরও নতুন ঋণ পাচ্ছে ওইসব গ্রুপ অব কোম্পানি। এ ব্যাংকের ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রেও পরিচালকরা অনিয়ম করেছেন বলে দুদকের তদন্তে পাওয়া গেছে। তবু কোনো পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়নি। নতুন প্রজন্মের আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোদ তার ১৮ বছর বয়সী ভাইঝিকে নিজের কোম্পানির পরিচালক বানিয়ে ভুয়া টিআইএন নম্বর দিয়ে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার ঋণ বাগিয়ে নিয়েছেন। এমন কি এই ঋণের জন্য যে সম্পদ জামানত নেওয়া হয় তারও অতিমূল্যায়ন দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ওই অনিয়ম ধরা পড়েছে। এদিকে একটি প্রতারক চক্র কখনো কখনো ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশেও ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এক্ষেত্রে বন্ধকী সম্পত্তি অতিমূল্যায়িত করে, ভুয়া এলসি খুলে কিংবা জাল সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর বন্ধক রাখার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ ঋণখেলাপি সৃষ্টি হয়েছে। গত সোমবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে অন্তত ১০০ ঋণ খেলাপির তালিকা প্রকাশ করেন, যারা ঋণ নিয়েও পরিশোধ করছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংক খাতের শতাধিক ঋণগ্রহীতার হদিস মিলছে না। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। অনেকে আবার বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এসব ঋণগ্রহীতাকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। একদিকে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে তাদের মর্টগেজ সংক্রান্ত কাগজপত্রও ভুয়া। এই প্রতারক ঋণগ্রহীতারা ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে বলে জানা গেছে। এর সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রথম সারির বেসরকারি ব্যাংকের টাকা। শুধু তাই নয়, নতুন ব্যাংকগুলোতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে একাধিক। এই প্রতারকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ রয়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায়ও এদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এদের ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই দেশের ব্যাংকিং খাতে সীমাহীন দুর্নীতি আর লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। যা এ খাতকে দুরবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংকিং খাতের ভিতরে সুশাসন না থাকা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথভাবে দেখভাল না করা ও অর্থ বিভাগের তদারকির ঘাটতি রয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু এগুলোর বাইরে সবচেয়ে বড় কথা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। রাজনৈতিক সিগন্যাল না থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতারও প্রয়োগ করা যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *