স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তীকালে সবচেয়ে শীতল সম্পর্ক এখন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার। সিরিয়া, ইউক্রেন ইস্যুতে দুই দেশ মুখোমুখি অবস্থানে। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর তত্পরতা, মার্কিন নির্বাচনে কথিত রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ দু’পক্ষের বৈরিতা-অবিশ্বাস আরো বাড়িয়েছে। উত্তর কোরিয়া ইস্যুতেও ওয়াশিংটনের বিপরীত অবস্থানে রয়েছে মস্কো। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এমন দ্বন্দ্বমুখর সময়েই প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। জার্মানির হামবুর্গে দুই নেতা পরস্পরের সঙ্গে করমর্দন ও বৈঠক করেছেন। জি২০ সম্মেলন চলাকালে ট্রাম্প-পুতিনের এ বৈঠককে রুশ প্রচার মাধ্যম ‘সম্মেলনের মধ্যে আরেক সম্মেলন’ বলে অভিহিত করেছে। খবর ওয়াশিংটন পোস্ট ও রাশিয়া টুডে।
জি২০ সম্মেলন শুরুর কিছুক্ষণ আগে মার্কিন ও রুশ নেতার সরাসরি সাক্ষাৎ এবং করমর্দনের ঘটনা ঘটে। হামবুর্গ শহরে সমবেত নেতারা সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক সূচনার আগে একটি কক্ষে অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় তাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা চলছিল। একপর্যায়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এগিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে যান। রুশ প্রেসিডেন্ট তখন ইউরোপিয়ান কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্কের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ট্রাম্প পুতিনের দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দেন। পুতিনও তখন হাত বাড়িয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে করমর্দন করেন। এ পর্যায়ে ট্রাম্প তার বাম হাতটি নিয়ে পুতিনের করমর্দনরত ডান হাতের কনুই ছুঁয়ে দেন। রুশ প্রেসিডেন্টের বামপাশে ছিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ট্রাম্প-পুতিনের করমর্দনের দিকে তাকিয়ে তিনি হাসছিলেন।
সব জনমত জরিপ ও বিশ্লেষণকে হার মানিয়ে গত নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার জয়ের পেছনে রাশিয়ার ভূমিকা ছিল বলে যুক্তরাষ্ট্রে অনেকের অভিযোগ। বিষয়টি ঘিরে বিতর্ক ও তদন্তের জেরে বিদায় নিতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাকে। এদের মধ্যে এফবিআই প্রধানের পাশাপাশি রয়েছেন ট্রাম্পের মনোনীত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাও।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার নির্বাচনী কর্মকর্তাদের রুশসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ঘিরে মার্কিন জনমনে এক ধরনের ধোঁয়াশা বিরাজ করছে। একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কেও। সিরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে বিপরীতে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। দেশটিতে চলমান সংঘাতে রাশিয়ার অংশগ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রের মুখ রক্ষা দায় হয়ে পড়েছে। সিরিয়া ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে ওঠা মেরুকরণেও রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো পরস্পরবিরোধী অবস্থানে গেছে। সিরিয়ার আকাশসীমায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিমান চলাচল সমন্বয়ের বিষয়ে ওয়াশিংটন-মস্কোর সমঝোতাও রদ হয়ে গেছে।
ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ওই নিষেধাজ্ঞার পরিধি আরো বড় করেছে। জর্জিয়া, পোল্যান্ডসহ পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশেও ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি ক্রমশ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। একসময় রুশ প্রভাব বলয়ে থাকা এসব দেশে ন্যাটোর অস্ত্র সমাহারকে রাশিয়া স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলমান ‘বেষ্টিকরণ’ প্রয়াস হিসেবে দেখছে। জি২০ সফর উপলক্ষে জার্মানি যাওয়ার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার পোল্যান্ড সফর করেন। সেখানে বক্তৃতাকালে তিনি রাশিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘উত্তরের দেশটি বিপজ্জনক আচরণের জন্য কঠিন পরিণতির মুখোমুখি হবে।’
এর আগে বৃহস্পতিবার উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেয়। মার্কিন সরকার উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করলে রাশিয়া তার বিরোধিতা করে। পাল্টা প্রস্তাবে রুশ প্রতিনিধি বলেন, উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র কর্মসূচি বন্ধের বিষয়ে রাশিয়া-চীনের যৌথ উদ্যোগ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক মহড়া বন্ধ করতে হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অনেকে হঠকারী নেতা বলে অভিহিত করেছেন। এদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বলা হয় উচ্চাভিলাষী। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান বিস্ফোরক পরিস্থিতি এবং তাতে দুই নেতার পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ অবস্থায় হামবুর্গে ট্রাম্প ও পুতিনের প্রথম সাক্ষাতের দিকে দৃষ্টি ছিল অনেকেরই। এ আগ্রহে নতুন মাত্রা যোগ করে মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার কথিত হস্তক্ষেপের অভিযোগ।
ট্রাম্প-পুতিন সাক্ষাৎ নিয়ে আগ্রহের মাত্রা বোঝা যায় প্রচার মাধ্যমের সংবাদ শিরোনামে। ব্রিটিশ দৈনিক ডেইলি মেইল দুই নেতার সাক্ষাতের খবরে শিরোনাম করেছে, ‘যে করমর্দনের অপেক্ষায় ছিল বিশ্ব’। রাশিয়া টুডে দুই নেতার সাক্ষাৎকে বলেছে, ‘সম্মেলনের মধ্যে আরেক সম্মেলন’।
প্রথম দফায় অনানুষ্ঠানিক করমর্দনের পর হামবুর্গে ট্রাম্প-পুতিন গতকাল আনুষ্ঠানিক বৈঠকেও অংশ নেন। বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় দ্বিপক্ষীয় এ বৈঠকের কারণে দুই নেতা জি২০ ফোরামের পরিবেশ-বিষয়ক ওয়ার্কিং সেশনেও যোগ দেননি। দুই ঘণ্টার বেশি সময় পর বৈঠকটি শেষ হয়। বৈঠকে দুই নেতা সিরিয়ায় যুদ্ধ বিরতির বিষয়ে একমত হন বলে জানা গেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ছাড়া দুই দেশের আরো কোনো কর্মকর্তা বৈঠকে ছিলেন না বলে জানা গেছে। আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং না হওয়ায় বৈঠকের ফলাফল জানা যায়নি। তবে বৈঠকের আগে দু’পক্ষই ফলপ্রসূ আলোচনার আশা প্রকাশ করে। পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের খবর জানিয়ে ট্রাম্প টুইটারে লেখেন, ‘পুতিনের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার অপেক্ষায় আছি।’ অন্যদিকে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘সিরিয়া, উত্তর কোরিয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হবে।’