মংলায় ওরিয়নের বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন না দেয়া ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় অংশ বাস্তবায়ন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি। সেই সঙ্গে কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষার (এসইএ) ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগকেও সাধুবাদ জানিয়েছে তারা। এ সমীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুন্দরবনের আশপাশে বড় ধরনের শিল্প ও অবকাঠামো নির্মাণ না করার আহ্বান জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারে সুন্দরবনের সংরক্ষণ পরিস্থিতি ও প্রদত্ত সুপারিশের বাস্তবায়ন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে কমিটি, যা কমিটির ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় ৪৩তম অধিবেশনে পর্যালোচনা করা হবে। তার ভিত্তিতেই রামপাল বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি।
পোল্যান্ডের ক্রাকোয় চলছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম অধিবেশন। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম অধিবেশ শুরু হয় ২ জুলাই, যা ১২ জুলাই শেষ হওয়ার কথা। কমিটির বৈঠকে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি সুন্দরবন ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল-সংশ্লিষ্ট আরো বেশকিছু বিষয় উঠে আসে। বৈঠকে এসইএ প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত খসড়া সিদ্ধান্তের নবম অনুচ্ছেদে করা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার অনুরোধটি স্থগিতের প্রস্তাব দেয় তুরস্ক। প্রাথমিকভাবে এ প্রস্তাব গৃহীত হলেও পরবর্তীতে ফিনল্যান্ডের প্রতিনিধির প্রস্তাবনা অনুযায়ী তাতে আরেকটি সংশোধনী যোগ করা হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সুন্দরবনের ওপর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পটির প্রভাব নিয়মিতভাবে যাচাই করা ও তা কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে।
খসড়া সিদ্ধান্তে কমিটির পক্ষ থেকে সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল, এসইএ সম্পন্নের আগ পর্যন্ত যাতে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বড় ধরনের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা হয়। একই সঙ্গে এতে এসইএ সম্পন্নের সঙ্গে সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব কমিটিতে সমীক্ষা প্রতিবেদন নিরীক্ষণের জন্য জমা দেয়ার অনুরোধ করা হয়ে। সংশোধিত প্রস্তাবনায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে উল্লেখ না করে বলা হয়েছে, এসইএ সম্পন্নের আগ পর্যন্ত যাতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বড় ধরনের কোনো অবকাঠামো বা শিল্প প্রকল্পের বাস্তবায়ন না করা হয়।
খসড়া সিদ্ধান্তে তেল ও রাসায়নিক নিঃসরণের ক্ষতিকর প্রভাব ঠেকানোয় গৃহীত পরিকল্পনা ‘ন্যাশনাল অয়েল স্পিল অ্যান্ড কেমিক্যাল কন্টিনজেন্সি প্ল্যানের’ খসড়া প্রণয়নের জন্য সরকারকে সাধুবাদ দেয় কমিটি। একই সঙ্গে এ পরিকল্পনা গৃহীত হওয়ার পর তা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও লোকবল নিয়োগের জন্যও অনুরোধ জানানো হয়।
সরকারকে পশুর নদীতে পরবর্তী কোনো ড্রেজিং কার্যক্রম চালানোর আগে সুন্দরবনের আউটস্ট্যান্ডিং ইউনিভার্সাল ভ্যালুর (ওইউভি) ওপর এর প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা চালানোর অনুরোধ জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে নৌ-চলাচল নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি স্থাপনের পাশাপাশি সুন্দরবনের ওপর ড্রেজিংয়ের মতো সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রমের নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনার লক্ষ্যেও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।
বায়ু ও পানিদূষণ, বর্ধিত নৌ-চলাচল ও ড্রেজিং কার্যক্রম এবং নদীর পানি উত্তোলনের মাধ্যমে সুন্দরবনের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ ধরনের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায় বলে কোনো ধরনের প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় সংশোধিত সিদ্ধান্তে আইইউসিএনের সুপারিশমালার ভিত্তিতে পরিচালিত এসইএ সমীক্ষার মাধ্যমে এসব প্রভাব নির্ণয়ের অনুরোধ জানায় কমিটি। আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারে জমা দেয়ার অনুরোধ করা হয়। ২০১৯ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪৩তম অধিবেশনে সরকারের কমিটির প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে অগ্রগতি ও এসইএ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রামপাল নিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত জানাবে কমিটি।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) লিমিটেডের যৌথ বিনিয়োগে রামপালে নির্মিত হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ লক্ষ্যে পিডিবি ও এনটিপিসি যৌথভাবে ২০১৩ সালে গঠন করে বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার ও সুন্দরবন বাফার জোন থেকে চার কিলোমিটার দূরে এ কেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে ১ হাজার ৮৩৪ একর জমি।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৩০ শতাংশ সমানভাবে অর্থায়ন করবে পিডিবি ও এনটিপিসি। বাকি ৭০ শতাংশ ঋণসহায়তা নেয়া হবে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রামপালের ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিটটির উৎপাদনে আসার কথা।