কেন বা কীভাবে হলো, কারা এরজন্য দায়ী এ ব্যাপারে কোনো জবাবদিহীতা করা হয়নি। নকশা তৈরিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাদের কাছে চিঠি দিয়েও কোনো জবাব চাওয়া হয়নি। এমনকি দেখা যাচ্ছে, সেই ত্রুটিপূর্ণ নকশায়ই ফ্লাইওভার নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা রহস্যজনক। কেন ত্রুটিপূর্ণ নকশায় ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ শুরু করা হলো এব্যাপারেও কোনো জবাব নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এদিকে ফ্লাইওভার নির্মাণের ঠিকাদার নিয়োগে তো হয়েছে আরো বড় রকমের অনিয়ম। শীর্ষকাগজের গত ২০তম এবং ২১তম সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে ঠিকাদার নিয়োগের ওইসব অনিয়মের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। শুধু তাই নয়, অবাক ব্যাপার হলো, নকশা পর্যালোচনা এবং নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য যে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাতেও ব্যাপক দুর্নীতি-জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চেষ্টা করা হয়েছিলো শীর্ষকাগজের পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে বেশ ক’বার। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি। ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে, সকল দুর্নীতিকেই জায়েজ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি যথাযথ যুক্তি ছাড়াই দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, অর্থব্যয় বাড়ানো হয়েছে লাগামহীনভাবে। শুধু তাই নয়, এতো অর্থব্যয়, সময়ব্যয় ও জনভোগান্তির পরও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, এই ফ্লাইওভার প্রকল্প থেকে প্রয়োজনীয় উপযোগিতা আদৌ পাওয়া যাবে কিনা? ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে নির্মাণ কার্যক্রম চালানোর কারণেই এ প্রশ্নটি সামনে এসে যাচ্ছে। যা এক ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতিই বটে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এরজন্য অন্যতম দায়ী অস্ট্রেলীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্মেক এবং মন্ত্রণালয় ও এলজিইডি কর্মকর্তারা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার কারণেই দফায় দফায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে। এর সুযোগ নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা এলজিইডি এবং মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে যোগসাজশে দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। তারপরও কাঙ্খিত মান অনুযায়ী ফ্লাইওভার নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সূত্রমতে, স্মেককে মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের পরামর্শক নিয়োগে নানারকমের জাল-জালিয়াতি ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছিলো। নকশা পর্যালোচনা এবং নির্মাণ কাজ তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো এ প্রতিষ্ঠানটিকে। শুরুতে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্মেক স্থানীয় তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গঠন করে টেন্ডারে অংশ নেয়। কিন্তু, যে ক্রাইটেরিয়া ও যেসব শর্তে এ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিকে প্রথম গ্রহণযোগ্য দরদাতা বিবেচনা করা হয়েছিলো এবং কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিলো, কার্যাদেশ পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি তা চরমভাবে লঙ্ঘন করে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের হয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য যেসব বিশেষজ্ঞ এ প্রকল্পে কাজ করার কথা টেন্ডারে উল্লেখ করা হয়েছিলো তা পরে পরিবর্তন করা হয়। জানা গেছে, বিশেষজ্ঞ পরিবর্তনের বিষয়টি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি নাকচও করে দিয়েছিলো। তারপরও এলজিইডির তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান পিপিআর লঙ্ঘন করে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে নিজে নিজেই এটি অনুমোদন করেন। এমনকি তখন এতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ মন্ত্রণালয়েরও অনুমোদন নেওয়া হয়নি। যা ডিটেইল প্রজেক্ট প্ল্যান (ডিপিপি) এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) এর চরম লঙ্ঘন। সূত্র বলছে, ২০১২ সালের ১২ জুন থেকে ১৭ মাসের জন্য অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক স্মেক (এসএমইসি) ইন্টারন্যাশনাল এবং দেশিয় এসিই কনসালট্যান্ট লিমিটেড, এসএআরএম কনসালট্যান্ট লিমিটেড ও ক্রান্তি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড নামক যৌথ পরামর্শক সংস্থার সঙ্গে ১৩ কোটি ৭ লাখ টাকার চুক্তি করে এলজিইডি। চুক্তির পর পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) লঙ্ঘন করে ডেপুটি টিম লিডার (ডিটিএল) ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার পরিবর্তন করে পরামর্শক সংস্থাটি। উল্লেখ্য, পরামর্শক সংস্থা নিয়োগের ক্ষেত্রে দুই খাম বিশিষ্ট দরপত্রে টেকনিক্যাল অফারই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে। টেকনিক্যাল অফার মূল্যায়নে নম্বর বেশি থাকে এবং বিশেষ করে এর ভিত্তিতেই গ্রহণযোগ্য দরদাতা বিবেচিত হয়। টেকনিক্যাল লোকবল অর্থাৎ কোন কোন বিশেষজ্ঞ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে কাজ করবেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার ওপর নম্বর দেওয়া হয়। গ্রহণযোগ্য দরদাতা নির্বাচনের জন্য এসব ক্ষেত্রে এটাই প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হয়। টেকনিক্যাল লোকবল পরিবর্তন করা হলে প্রকল্পের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। এ কারণেই টেন্ডার গৃহীত হওয়ার পর টেকনিক্যাল লোকবল পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না। কখনো পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের টেকনিক্যাল লোকবল পরিবর্তনের অপরিহার্যতা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে নিয়ম হলো, টেন্ডার জমা দেওয়ার সময় যার নাম উল্লেখ করা হয়েছিলো পরবর্তী অর্থাৎ নতুন ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা তার সমান অথবা তারচেয়ে বেশি থাকতে হবে। পূর্বের ব্যক্তির চেয়ে কম হলে তা কোনো ক্রমেই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। ব্যক্তি পরিবর্তনের এই পুরো বিষয়টি মূল্যায়ন করবে পূর্বের মূল্যায়ন কমিটি, যে কমিটি ইতিপূর্বে টেন্ডার মূল্যায়ন করেছিলো। মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়নে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হওয়ার পর তাতে যথাযথ কর্তৃপক্ষেরও অনুমোদন নিতে হবে। এক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বলতে শুধুমাত্র তাদেরই বোঝায়, ইতিপূর্বে টেন্ডার বা কার্যাদেশ চূড়ান্ত করার সময় যেসব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়েছিলো। এটাই হলো পিপিআর-এর শর্ত। পিপিআর ২০০৮ এর ১১৯ (৫) ধারায় এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে, প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (কী-পারসনাল) পরিবর্তন করা যাবে না। পরিবর্তন অত্যাবশ্যকীয় হলে তা পুনরায় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) কর্তৃক মূল্যায়ন করতে হবে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। অথচ এসব নিয়ম না মেনেই মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভার প্রকল্পে বিধি বহির্ভূতভাবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ‘কী-পারসন’দের পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারে স্মেকের সঙ্গে সম্পাদিত মূল চুক্তিতে ডিটিএল (ডেপুটি টিম লিডার) ছিলেন আব্দুল মান্নান। তার পরিবর্তে ফরিদ আহমেদকে নেওয়া হয়েছে। এবং ষ্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন জাপানের ড. হিদো ম্যাতসুসিমা। তার পরিবর্তে রবার্ট জে আ্যাবেসকে নেওয়া হয়েছে। অথচ প্রতিমাসে ২০ লাখ টাকা বেতন গ্রহণকারী এই নতুন ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট জে অ্যাবেস এ সংক্রান্ত কোনো ডিজাইনই তৈরি করতে পারেন না। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পিপিআর অনুযায়ী পিইসির পুনঃমূল্যায়ন হলে নিয়োগপ্রাপ্ত পরামর্শক সংস্থা স্মেক কাজের অযোগ্য হয়ে যেত। চুক্তির শর্তেই তা বলা আছে। এক্ষেত্রে কাজ পেতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা ডিপিএম-এআইএ জেবি নামে প্রতিষ্ঠানটি পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেত। এতে রাষ্ট্রের প্রায় পাঁচ কোটি টাকা সাশ্রয়ও হতো। অপরদিকে ষ্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট জে আ্যাবেস অদক্ষ হওয়ায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)কে পরবর্তীতে চার কোটি টাকা চুক্তিতে ডিজাইন কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিতে হয়েছে। কিন্তু ডিপিপিতে ওই প্রকল্পের জন্য কেবলমাত্র একটি পরামর্শক সংস্থা নিয়োগের শর্ত রয়েছে। ডিজাইন মূল্যায়ন এবং কাজ তদারক করার দায়িত্ব ওই একটি সংস্থারই থাকার কথা। সেই অনুযায়ীই স্মেককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে ফ্লাইওভারটির ডিজাইন তৈরি বাবদ পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্মেক-এর কাজ ছিলো সেই ডিজাইন মূল্যায়ন এবং তদারক করা। অথচ ডিপিপি লঙ্ঘন করে স্মেক-এর বাইরে অতিরিক্ত পরামর্শক হিসেবে বুয়েটকে নিয়োগ দেওয়া হয় ডিজাইন মূল্যায়নের জন্য। যেহেতু স্মেক-এর নিয়োজিত ইঞ্জিনিয়ার ডিজাইন মূল্যায়ন করতে পারছিলো না সে কারণেই এটি করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের অতিরিক্ত আরো চার কোটি টাকা খরচ হয়েছিলো। অর্থাৎ সব মিলিয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ বাবদ সরকারের প্রায় ৯ কোটি টাকা গচ্ছা গেছে শুদুর্নীতিবাজদের সরকারি অর্থ আত্মসাত প্রবণতার কারণে। শুধু তাই নয়, পরামর্শক নিয়োগে এমন দুর্নীতির কারণে পুরো ফ্লাইওভারটিই ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মিত হচ্ছে। নির্মাণ কাজে অতিরিক্ত সময় এবং শ’ শ’ কোটি টাকা ব্যয় তো বেড়েছেই।