গাজীপুর: সোমবার সন্ধ্যায় এক পোশাক কারখানায় ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে কারখানার ১১ কর্মী নিহত এবং অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিস্ফোরণে ভবনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার একাংশ ধসে পড়েছে। নিহতদের মধ্যে একজনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। তার নাম আল আমিন (৩০)। তার বাড়ি কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকায়।
তিনি ওই কারখানার সিনিয়র ডায়িং অপারেটর। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ দিকে কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনায় কারখানাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও একই ঘটনায় ওই এলাকার প্রায় সব ক’টি কারখানা মঙ্গলবার ছুটি ঘোষণা করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। রাত সাড়ে ১১টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধারকাজ করছিলেন। বিস্ফোরণে হতাহতদের অধিকাংশই বয়লার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী।
ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, আহত শ্রমিক ও এলাকাবাসী জানান, ঈদের ছুটির পর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকাস্থিত মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড নামে পোশাক কারখানাটি মঙ্গলবার খোলার কথা ছিল। তবে সোমবার ডাইং ইউনিটের বয়লার সেকশনটি চালু ছিল। কারখানার একটি চারতলা ভবনের নিচতলার ডায়িং ও ফিনিশিং সেকশনে এবং দ্বিতীয় তলার নিটিং সেশনে ৮০-৯০ জন শ্রমিক কাজ করছিলেন। এ ভবন সংলগ্ন একটি টিন শেডে ৭ টন ও ১০ টনের দু’টি বয়লার ছিল।
সোমবার এ বয়লার দু’টি চালু করা হয়। সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে ৭ টনের বয়লারটি হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতে চারতলা ওই ভবনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার দুই পাশের দেয়াল, দরজা-জানালা ও মেশিনপত্র উড়ে যায় এবং বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন শ্রমিক হতাহত হন। এ ছাড়াও কারখানার সামনের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী বেশ কিছু সাধারণ মানুষও আহত হয়। বিস্ফোরেণের ফলে এমা গার্মেন্টস, ইসলাম গ্রুপের ইউনিট-২, তাসনিয়া ও মৌরিশাস গার্মেন্টসসহ আশপাশের কারখানার ভবনগুলো কেঁপে ওঠে এবং দরজা-জানালার কাচ ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। বিস্ফোরিত বয়লার টুকরো টুকরো হয়ে অন্তত ৫ শ’ গজ দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। এক শ্রমিকের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় দু শ’ গজ দূরে এক ভবনের চালের ওপর পড়ে। এ ছাড়াও নিহত আরো কয়েক শ্রমিকের ছিন্ন ভিন্ন দেহ ঘটনাস্থলে পড়ে থাকে। এতে আশপাশের শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার পরপরই ওই এলাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। স্থানীয়রা এগিয়ে এসে হতাহতদের উদ্ধার করে কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সাভারসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও কিনিকে পাঠাতে থাকেন। খবর পেয়ে জয়দেবপুর, কালিয়াকৈর, টঙ্গী ও সাভার ইপিজেড ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধারকাজ শুরু করেন।
গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক প্রণয় ভূষণ দাশ জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় রাত ৯টা পর্যন্ত পাঁচজনের লাশ এবং গুরুতর আহতাবস্থায় রোকন মিয়া (২৫) নামে এক শ্রমিককে হাসপাতালে আনা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
নিহতের সংখ্যা ১১ জনে উন্নীত
গাজীপুর জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আক্তারুজ্জামান ও জয়দেবপুর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম জানান, কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত মোট ১১ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। তবে নিহতের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সম্পূর্ণ কারখানা চালু থাকলে হতাহতের সংখ্যা আরো অনেক বৃদ্ধি পেতো।
এ দিকে ঘটনার খবর পেয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো: রাহেনুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাখাওয়াৎ হোসেন, কারখানার চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন ফারুক ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
তদন্ত কমিটি গঠন
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো: রাহেনুল ইসলামকে প্রধান করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের দাফন ও লাশ বহনের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে।
কারখানা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
দুর্ঘটনার পর কারখানার চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন ফারুক রাতেই ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি পরিস্থিতি দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এ সময় তিনি বলেন, কী কারণে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে কোনো অবহেলা বা গাফিলতি নেই।
কারখানা বন্ধ ঘোষণা
মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনায় রাতে কারখানাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কারখানার গেটে নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও একই ঘটনায় ওই এলাকার মণ্ডল গ্রুপের মনটেক্স, কটন কাব বিডি লি., কটন কাউড বিডি লি., আলিম নিট বিডি লি., মাস্কো গ্রুপের তাসনিয়া ফেব্রিক্সসহ প্রায় সব ক’টি কারখানা মঙ্গলবারের জন্য ছুটি ঘোষণা করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকায় মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড নামে এ পোশাক কারখানাটি ১৯৯২-৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কারখানায় সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, জাপান, রাশিয়া, স্পেন, নেদারল্যান্ডস ও ইউকেসহ বিভিন্ন দেশের কাজ করে থাকে।