প্রতিবারের মতো এবারও দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হলো কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়। সোমবার ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে আসা দেশ-বিদেশের লাখো মুসল্লির ভিড়ে জনসমুদ্রে পরিণত হয় শোলাকিয়া ময়দান। গত বছরের ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিয়ার পুলিশ চেকপোস্টে জঙ্গি হামলা ঘটনা ঘটায় এ নিয়ে মুসল্লিদের মাঝে অস্বস্তি থাকলেও তা বৃহত্তম এই জামাত আয়োজনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বরং ভয়কে জয় করে দেশের সর্ববৃহৎ এ জামাতে অংশগ্রহণ করতে ভোর থেকেই মুসল্লিদের ঢল নামে শোলাকিয়া ঈদগাহের উদ্দেশ্যে। জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত শোলাকিয়া ঈদগাহমুখি সকল সড়ক চলে যায় মুসল্লিদের দখলে। কয়েক ঘণ্টার জন্য এসব সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেবল শোলাকিয়া সেতু দিয়ে মুসল্লিদের ঈদগাহে যাতায়াতের জন্য কিশোরগঞ্জ-করিমগঞ্জ সড়ক খোলা রাখা হয়। জামাত শুরুর আগেই সাত একর আয়তনের বিশাল ঈদগাহ ময়দান কানায় কানায় ভরে যায়। আগত মুসল্লিদের অনেকে মাঠে জায়গা না পেয়ে পার্শ্ববতী রাস্তা, শোলাকিয়া সেতু ও নদীর পাড়ে জায়গা করে নিয়ে জামাতে শরিক হন।
১৮২৮ সালে অনুষ্ঠিত ঈদের প্রথম বড় জামাতের হিসাব অনুযায়ী শোলাকিয়া ময়দানে এবার ছিল ১৯০তম ঈদ জামাত। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া জামাতে ইমামতি করেন বাংলাদেশ ওলামা-মাশায়েখ সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান মাও. ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। জামাতকে কেন্দ্র করে নেওয়া হয় চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মাঠের চারপাশের অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসানো হয় নিরাপত্তা চৌকি। পুরো এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসানো ছাড়াও মাঠের ৬টি প্রবেশ আর্চওয়ে দিয়ে মুসল্লিদের দেহ তল্লশি করা হয়। সহ¯্রাধিক পুলিশ ও আর্মড পুলিশ ছাড়াও বিজিবি ও র্যাব সদস্যের কঠোর নিরাপত্তা ও নজরদারিতে শন্তিপূর্ণভাবে নামাজ শেষ হয়। নামাজ শেষে ইমাম তাঁর বয়ান ও মোনাজাতে জঙ্গিবাদকে ইসলামের শত্রু হিসেবে আখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদের পতন কামনা করেন। জঙ্গিবাদ রুখতে গিয়ে সে সকল পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করা হয়। এছাড়া দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর জন্য মঙ্গল কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। কয়েক লাখ মুসল্লির উচ্চকিত হাত আর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার আমীন, আমীন ধ্বনিতে এ সময় মুখরিত হয়ে উঠে পুরো ঈদগাহ এলাকা।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাহবুবুর রহমান, জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. জিল্লুর রহমান, পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান পিপিএম, কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ, পিপি শাহ আজিজুল হক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) উপসচিব তরফদার মো. আক্তার জামীল, সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান, সদরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আব্দুল্লাহ আল মাসউদসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এখানে ঈদের নামাজ আদায় করেন। ৪৭ বছর ধরে এ মাঠে নামাজ আদায় করছেন ময়মনসিংহের ভালুকার আখতার হোসেন ম-ল (১১২)। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে এখানে নামাজ পড়তে আসেন নরসিংদীর সুরুজ মিয়া (৭৭)। এ ধরণের অসংখ্য লোকের খোঁজ পাওয়া যায় যারা দীর্ঘদিন ধরে এখানে নামাজ আদায় করতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন।
মাঠের সুনাম ও নানা জনশ্রুতির কারণে ঈদের কয়েক দিন পূর্ব থেকেই কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সারাদেশের বিভিন্ন জেলা তথা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, জামালপুর, খাগড়াছড়ি, শেরপুর, যশোর, খুলনা ও চট্রগ্রামসহ অধিকাংশ জেলা থেকে শোলাকিয়ায় মুসল্লিদের সমাগম ঘটে। এদের অনেকেই ওঠেছিলেন হোটেলে, কেউবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ও শোলাকিয়া ঈদগাহ মিম্বরে। আবার অনেকেই কোথাও জায়গা না পেয়ে রাত কাটিয়েছেন বিভিন্ন মসজিদে।
ঈদের দিন শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ২টি স্পেশাল ট্রেন চলাচল করে। একটি ট্রেন ভৈরব থেকে সকাল ৬টায় ছেড়ে আসে এবং সকাল ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছায়। অন্যটি ময়মনসিংহ থেকে সকাল পৌনে ৬টায় ছেড়ে আসে এবং সকাল সাড়ে ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছায়।
এ ঈদ জামাতকে উপলক্ষ করে জেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কর্তৃক মুসল্লিদের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, জরুরী স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করেছে। এছাড়া বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের উপস্থিতি ও কর্মব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মত।
প্রতি বছরই ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিণত হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মহামিলন কেন্দ্রে। মহমিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। আল্লাহর সান্নিধ্য ও অনুকম্পা পেতে ব্যাকুল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ঢল নামে জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড়িয়ে আদায় করেন ঈদের নামাজ। সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে এক নতুন সমাজ গড়ার শিক্ষা নিয়েই জামাত শেষে বাড়ির পথে শোলাকিয়া ছাড়েন তাঁরা।