গত বছরের ৭ই জুলাই ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহের চেকপোস্টে হানা দেয় জঙ্গি দল। জঙ্গিদের এই হামলার পরিকল্পনা জীবনবাজি রেখে রুখে দেন লড়াকু পুলিশ সদস্যরা। পুলিশের বুকের তাজা রক্তে নির্বিঘ্ন হয় শোলাকিয়ায় উপমহাদেশের বৃহত্তম ঈদুল ফিতরের জামাত। ঈদগাহ ময়দানের অনতিদূরের জঙ্গি হামলা এড়িয়ে চার লাখ মুসল্লি শরিক হন সবচেয়ে বড় এই ঈদুল ফিতরের জামাতে। গতবার জঙ্গিরা হানা দেয়ায় এবার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরো ঢেলে সাজানো হয়েছে ঈদগাহ্ ময়দানকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিশ্ছিন্দ্র এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শহর এবং আশপাশের এলাকায় বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।
বিজিবি, র্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান, আরআরএফসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেড় হাজারেরও বেশি সদস্য দিয়ে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হচ্ছে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানকে। ঈদগাহ ময়দানের বাইরে, ভেতরে ও প্রবেশ পথে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ঈদগাহ ময়দান, আশেপাশের এলাকা এবং অলিগলিসহ মাঠ সংলগ্ন চারপাশের অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকা নিয়ে আসা হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় আওতায়। মাঠে স্থাপন করা হয়েছে আটটি ওয়াচ টাওয়ার। এর ছয়টিতে পুলিশ বাহিনী ও দুইটিতে র্যাব বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে ঈদজামাতের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা তদারকি করবেন। ঈদগাহ ময়দানের মোট ২১টি প্রবেশ পথের মধ্যে মুসল্লিদের জন্য ছয়টি প্রবেশপথ উন্মুক্ত রাখা হচ্ছে। সেসব প্রবেশপথে স্থাপিত আর্চওয়ে দিয়ে মুসল্লিদের ঢুকতে হবে ঈদগাহ ময়দানে। এর আগে আরো অন্তত তিন দফা মেটাল ডিটেক্টরে মুসল্লিদের দেহ তল্লাসি করা হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে মুসল্লিদের ছাতা বা কোনো ধরণের ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেয়া হবে না। শুধু পাতলা জায়নামাজ নিয়ে তারা আসতে পারবেন।
পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান পিপিএম জানান, শান্তিপূর্ণভাবে ঈদজামাত অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে মাঠের বাইরে, মাঠের ভেতরে ও প্রবেশ পথে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মাঠের ভিতর-বাহিরে পোশাক ও সাদা পোশাকে বিপুল পরিমাণ পুলিশ বাহিনীকে সহায়তা করবে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক দল। এরই মধ্যে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে পুলিশ। পুলিশের নিয়মিত সদস্যদের পাশাপাশি আট প্লাটুন বিজিবি ও ২০ প্লাটুন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া ঈদগাহ ময়দানকে ঘিরে মোতায়েন করা হবে বিপুল সংখ্যক র্যাব সদস্য। সার্বিক প্রস্তুতির বিবেচনায় নির্বিঘ্নে শোলাকিয়ায় মুসল্লিগণ ঈদুল ফিতরের জামাত আদায় করতে পারবেন বলে পুলিশ সুপার আশা প্রকাশ করেন।
এদিকে সুষ্ঠুভাবে ঈদজামাত আদায়ের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ ফোর্সকে আইনগত দিকনির্দেশনা দেয়াসহ ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল দায়িত্ব পালনের জন্য ঈদগাহ মাঠের বিভিন্ন পয়েন্ট ও এলাকায় ১৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়েছেন জেলা প্রশাসন। গৃহীত প্রস্তুতির বিবেচনায় লাখ লাখ মুসল্লির অংশগ্রহণে এবারো উৎসবমুখর পরিবেশে সুন্দর ও সুচারুভাবে ঈদজামাত অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস। তিনি জানিয়েছেন, শোলাকিয়ায় উপমহাদেশের বৃহত্তম ঈদজামাত আয়োজনের সকল প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সংস্কার করা হয়েছে মিনার, অজুখানা। মুসল্লিদের প্রাকৃতিক কাজ-কর্ম সারার জন্য তৈরি করা হয়েছে বেশকিছূ অস্থায়ী টয়লেট। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিদের সার্বিক নিরাপত্তা ও সুবিধার্থে এবছর মাঠের পাশেই অবস্থিত আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের হলরুমে থাকার সু-ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ ঈদগাহে আসা মুসল্লিদের আপ্যায়ন ও প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী স্বেচ্ছাসেবী ক্যাম্প। প্রস্তুত রাখা হয়েছে একাধিক মেডিকেল টিম। সব মিলিয়ে বৃহত্তম ঈদজামাতের জন্য ২৬৭ বছরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান পুরোপুরি প্রস্তুত বলে জানান জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস।
এবারের ১৯০তম ঈদুল ফিতরের জামাত শুরু হবে সকাল ১০টায়। এতে ইমামতি করবেন ইসলাহুল মুসলিহীন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। জনসমুদ্রে পরিণত হওয়া ঈদগাহ ময়দানে আগত মুসল্লিদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শর্টগানের গুলি ছুঁড়ে প্রতিবারের মতো এবারও জামাত শুরুর সংকেত দেয়া হবে। রেওয়াজ অনুযায়ী, জামাত শুরুর ৫ মিনিট আগে ৩টি, ৩ মিনিট আগে ২টি এবং ১ মিনিট আগে ১টি শর্টগানের গুলি ছোঁড়া হয়।
অন্যদিকে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিদের সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবারও ‘শোলাকিয়া এক্সপ্রেস’ নামে দু’টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। ভৈরব বাজার-ময়মনসিংহ ও ময়মনসিংহ-ভৈরব বাজার রুটে বিশেষ ট্রেন দু’টি চলাচল করবে। বিশেষ ট্রেনের একটি ঈদের দিন সকাল ৬টায় ভৈরববাজার থেকে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসবে এবং সকাল ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছবে। জামাত শেষে ট্রেনটি দুপুর ১২টায় পুনরায় ভৈরববাজারের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে এবং বেলা ২টায় ভৈরববাজার পৌঁছবে। অপর ট্রেনটি ঈদের দিন সকাল পৌনে ৬টায় ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে আসবে এবং সকাল সাড়ে ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছুবে। এ ট্রেনটিও জামাত শেষে দুপুর ১২টায় কিশোরগঞ্জ থেকে ছেড়ে যাবে এবং বেলা ৩টায় ময়মনসিংহ পৌঁছুবে।
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী এ শোলাকিয়া ঈদগাহ। বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশাখাঁ’র ষোড়শ বংশধর হয়বতনগরের জমিদার দেওয়ান মান্নান দাঁদ খান তার মায়ের অসিয়াত মোতাবেক ১৯৫০ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহের জন্য ৪.৩৫ একর জমি ওয়াক্ফ করেন। সেই ওয়াক্ফ দলিলে উল্লেখ রয়েছে, ১৭৫০ সাল থেকে এ মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সে হিসাব অনুসারে, শোলাকিয়া ঈদগাহের বয়স ২শ’ ৬৭ বছর। প্রতিষ্ঠার ৭৮ বছর পর ১৮২৮ সালে প্রথম বড় জামাতে এই মাঠে একসঙ্গে ১ লাখ ২৫ হাজার অর্থাৎ সোয়ালাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ আদায় করেন। এই সোয়ালাখ থেকে এ মাঠের নাম হয় ‘সোয়ালাখিয়া’, যা উচ্চারণ বিবর্তনে হয়েছে শোলাকিয়া। বৃহত্তম জামাতের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর এ ঈদগাহ মাঠে ১৯০তম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে। কিশোরগঞ্জ মৌজার এ মাঠের মূল আয়তন বর্তমানে ৬.৬১ একর। প্রাচীর ঘেরা শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে মোট ২২২টি কাতার রয়েছে যেখানে একসঙ্গে দেড় লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। এছাড়া মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ঈদগাহ সংলগ্ন খালি জায়গা, রাস্তা এবং নিকটবর্তী এলাকায় দাঁড়িয়ে সমসংখ্যক মুসল্লি এ বৃহত্তম ঈদজামাতে শরিক হন।