পুলিশের সামনেই অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগ

গ্রাম বাংলা রাজনীতি

নসরব

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

সিলেট: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডারদের শ’ শ’ রাউন্ড গুলিবিনিময়কালে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হয়েছেন। পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ কমপক্ষে ১০ জন গুলিবিদ্ধ হওয়া ছাড়াও অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে গুলিবিনিময় ও সংঘর্ষ ঘটে। নিহত ছাত্রলীগ কর্মী সুমন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সংঘর্ষের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ কারণে প্রশাসন জরুরি সভা করে বিশ্ববিদ্যলয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। একই সঙ্গে বিকাল ৪টার মধ্যে তিনটি হল থেকে ছাত্রদের ও দু’টি হল থেকে ছাত্রীদের আজ সকাল ৯টার মধ্যে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এদিকে, ছাত্রলীগ কর্মী সুমন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রায় তিন ঘণ্টা ঘেরাও করে রাখে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। এ সময় তাদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ কর্মীরা সুমনের মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতাল এলাকার জরুরি বিভাগের সামনে ১০টি যানবাহন ভাঙচুর করে। কয়েকটি দোকানেও হামলা চালায়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৬ বছরে বহুবার ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে বেশ কয়েকবার গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। প্রায় দেড় বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ কমিটির সভাপতি করা হয়েছিল সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থকে। আরেক ছাত্রলীগ নেতা অঞ্জন রায়কে করা হয়েছিল সহসভাপতি। কিন্তু কমিটি ঘোষণার পরপরই ছাত্রলীগের অঞ্জন গ্রুপের কর্মীদের সঙ্গে পার্থ গ্রুপের কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময়ও ক্যাম্পাসে গুলি ও ককটেল বিনিময়ের লড়াই চলে। রাতের আঁধারে তাণ্ডবের পর ছাত্রলীগের সভাপতি অর্থাৎ পার্থ গ্রুপের কর্মীরা ক্যাম্পাসে বাইরে চলে যায়। আর অঞ্জন গ্রুপের হাতে চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ। সেই হিসেবে ছাত্রলীগ সভাপতি পার্থ গ্রুপের সদস্যরা গত দেড় বছর ধরে ক্যম্পাসের বাইরে অবস্থান করছে। এর মধ্যে তারা কয়েক বার ক্যাম্পাসে ঢুকতে চাইলে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছিল। এদিকে, পার্থ গ্রুপের কর্মীরা গত কয়েক দিন ধরে পরিকল্পনা করে গতকাল সাড়ে ১০টার দিকে সশস্ত্র অবস্থায় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, পার্থ গ্রুপের কর্মীরা ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগে বেশ স্বাভাবিকভাবে চলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থী অবস্থান করছিল বিভিন্ন ক্লাসে ও পরীক্ষার হলে। তারা জানান, পার্থ গ্রুপের শতাধিক কর্মীর হাতে বন্দুক, লাঠি, দা, রামদা নিয়ে ক্যাম্পাসের শাহপরান হলের সামনে অবস্থান করে। তাদের সঙ্গে বহিরাগত ক্যাডারদের উপস্থিতি ছিল বেশি। এ সময় তারা শাহপরান হলের সামনে কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। একপর্যায়ে পার্থ গ্রুপের কর্মীরা সশস্ত্র অবস্থায় ক্যাম্পাসে মিছিল বের করে। মিছিলটি ক্যাম্পাসের গোল চত্বর এলাকা ঘুরে আবার হলের সামনে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় হলের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে পার্থ গ্রুপের কর্মীরা। তারা ৫-৭টি ককটেল ফাটিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। এদিকে, পার্থ গ্রুপের কর্মীদের ক্যাম্পাসে অবস্থান দেখে শাহপরান হলসহ অপর দু’টি হলে অবস্থানকারী অঞ্জন গ্রুপের কর্মীরা জড়ো হয়ে মিছিল বের করে। আর দু’টি মিছিল মুখোমুখি হলেই শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। প্রথমে উভয়পক্ষের কর্মীরা হাতে থাকা লাঠি, রামদা, দা-সহ দেশী অস্ত্র দিয়ে হামলা পাল্টা হামলা চালায়। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মী আবদুস সালামসহ কমপক্ষে ২০ জন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী আহত হন। এর মধ্যে আবদুস সালামসহ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিকে, প্রথম পর্যায়ে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে হামলা পাল্টা হামলা চালানো হয় শুরু হয় গোলাগুলি। হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা জানায়, বেলা পৌনে ১১টা থেকে দু’পক্ষের মধ্যে বৃষ্টির মতো গুলির লড়াই চলে। প্রথমে মুখোমুখি গুলিবিনিময় হলেও পরে তারা দু’টি হলের আড়ালে অবস্থান নিয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। একপর্যায়ে গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা ক্যাম্পাস। অনবরত গুলিবিনিময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাম্পাসের গোল চত্বর এলাকায় অবস্থান করলেও পরিস্থিতি শান্ত করতে কেউ এগিয়ে যায়নি। গুলিবিনিময়কালে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ছাত্রলীগ কর্মী দাসসহ কয়েকজন। তাদের শাহপরান হলের ফটক দিয়ে বাইরে বের করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গুলিবিনিময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরদের সঙ্গে নিয়ে অ্যাকশন শুরু করে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনতে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের অ্যাকশনের মুখে দুপুর ১২টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ সিনিয়র শিক্ষকরা সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হলেও ছাত্রলীগের পার্থ ও অঞ্জন গ্রুপের কর্মীরা দু’দিকে অবস্থান নেন। অবস্থানকালে তারা সশস্ত্র অবস্থায় ছিল। এ সময় কয়েকজন সাংবাদিক দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাদেরও ধাওয়া করা হয়। অস্ত্র তাক করে দেয়া হয় হুমকিও। ফলে সাংবাদিকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বর এলাকায় অবস্থান করেন। এ অবস্থায় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আরেক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। প্রায় আধ ঘণ্টা চলে থেকে থেমে সংঘর্ষ। পুলিশ গিয়ে দু’পক্ষের মাঝখানে অবস্থান নেয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এদিকে, বেলা দেড়টার দিকে ফের ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ ও গুলিবিনিময় ঘটে। পুলিশ ফাঁকা গুলি ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিমাদ্রি শেখর পুলিশের রাবার বুলেটে গুলিবিদ্ধ হন। আর ছাত্রলীগের হাতে আহত হন পুলিশের একজন এসআইসহ দু’জন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও পুলিশের সতর্ক অবস্থানের কারণে বেলা ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। সংঘর্ষকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থাকা হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা প্রাণ বাঁচাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিক দিয়ে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। আর ছাত্রীরা অবস্থান নেন দু’টি হলে। এ সময় হলের সামনেও ককটেল ও গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটলে ভয়ে চিৎকার শুরু করেন তারা। ওদিকে গুলিবিনিময় ও সংঘর্ষকালে গুরুতর আহতদের সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুপুর ১২টার দিকে বুকে গুলিবিদ্ধ সুমন দাস মারা যান। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ কর্মীরা জরুরি বিভাগের সামনে তাণ্ডব চালিয়ে ১০ থেকে ১২টি যানবাহনে ভাঙচুর চালায়। এ সময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। পুলিশকে হটিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগ প্রায় দু’ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। এ সময় লাশের ছবি তুলতে গিয়ে অপদস্থ হন কয়েকজন সাংবাদিক। বেলা ২টা পর্যন্ত জরুরি বিভাগের সামনে অবস্থান করেন ছাত্রলীগ কর্মীরা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। এ কারণে জরুরি বিভাগে থাকা রোগীরা ভয়ে হাসপাতাল এলাকা ছেড়ে চলে যান। এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আমিনুল হক ভূঁইয়াসহ সিনিয়র শিক্ষকরা, সিন্ডিকেট সদস্য, প্রক্টরিয়ার বডি, প্রভোস্ট বডির সদস্যরা জরুরি বৈঠক করে। বৈঠক শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ড. কবির আহমদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিকাল চারটার মধ্যে তিনটি হলের ছাত্রদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাকি দু’টি ছাত্রী হলের শিক্ষকরা আজ সকাল ৯টার মধ্যে হলত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমদ জানিয়েছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে। বেলা আড়াইটার দিকে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত ছাত্রলীগের দু’টি গ্রুপই চলে যায়। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি মিডিয়া মো. রহমতল্লাহ জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যতটুকু পুলিশের সহায়তা চেয়েছেন পুলিশ ততটুকু সহায়তা দিয়েছে। তিনি বলেন, রাবার বুলেট, ফাঁকা গুলি ও টিয়ারশেল ছুড়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে বলে জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *