ঢাকা: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ ২৩ জুন। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দলটির আজকের এই অবস্থান। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ভর করে পথচলা শুরু, এরপর সময়ের ব্যবধানে নীতি, নেতা আর নেতৃত্বে এসেছে পরিবর্তন। কখনো অভিযোগ উঠেছে, ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে আপসের, আবার কখনো বিরোধী মত দমনের। তবে দলের শীর্ষ সারির নেতৃত্ব বলছেন, ভবিষ্যতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে—এটাই তাঁদের প্রত্যাশা।
আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের পথচলা কেমন হবে, তা বলার চেষ্টা করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এরপর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় আসে। তারপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৪টি আসনে বিনা ভোটে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। এই মুহূর্তে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেমন প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে, তেমনি বিএনপিও চাইছে নির্বাচনে অংশ নিতে। নির্বাচন সামনে হওয়ায় অনেকে অভিযোগ করছেন হেফাজতের সঙ্গে সরকার সমঝোতার চেষ্টা করছে। আবার বিরোধী বিএনপি অভিযোগ করছে, আওয়ামী লীগ চায় না বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসুক।
বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ইদানীং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের একধরনের আপস লক্ষ করা যাচ্ছে। যদি গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস থাকত, তাহলে আওয়ামী লীগ হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করত না। আর হেফাজতে ইসলামও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারত না। আবার ধর্মীয় দিক থেকে সবকিছু বিবেচনা করাও যাবে না। সাম্প্রদায়িক, অসাম্প্রদায়িক বিষয়ের চেয়ে বড় কথা জনগণের অধিকারবোধ। জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করা যাবে না। আইনের সামনে সবাই সমান। এরপরও দেখা গেল, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর হামলা করা হলো। এটাই কিন্তু ব্যক্তি অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়া।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, কে কাকে নিয়ে শাসনকাজ চালাল, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, গণতন্ত্র সঠিকভাবে চর্চা হচ্ছে কি না। আর গণতান্ত্রিক চর্চার বিকল্পও নেই। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের জন্মই হয়েছিল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধরে রাখতে, গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে অবশ্যই কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগের অতীত আছে। সেই অতীতকে উজ্জ্বল রাখতে হলে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকল্প নেই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, বাংলাদেশে এখন যেসব দল আছে তার মধ্যে দ্বিতীয় প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। গত সাত দশকে দলের নেতৃত্ব ও নীতিতে অনেক বদল এসেছে। ধর্মের কাছে এমন নতি আওয়ামী লীগের ৭০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়নি। এর আগে ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধ করা হয়েছে। অসাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের স্বার্থে তারা সোচ্চার ছিল। এখন দলটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যুক্ত হওয়ায় পার্থক্যগুলোও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, বিএনপি এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে সত্য। আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিতবেও হয়তো, কিন্তু সেটি হবে নেতিবাচক ভোট। তেমন বিজয় সরকারকে শক্তিশালী করবে না। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে আওয়ামী লীগ, ১৪ দল কিংবা সরকারের ওপর কারও আস্থা নেই। আস্থা আছে কেবল শেখ হাসিনার ওপর। এটি প্রধানমন্ত্রী, সরকার বা দেশের জন্য শুভ নয়। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ হয়তো নির্বাচনের ও দেশের স্বার্থে হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। এটা হতেই পারে। কিন্তু বারবার এমন সমঝোতা করলে মূল আদর্শ হতে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি।’
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইতিহাস বলে যে আওয়ামী লীগ আপসের রাজনীতি করে না। তবে আলোচনার ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠাকে প্রাধান্য দেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। আজ আওয়ামী লীগ ৬৯ বছরে পদার্পণ করেছে। জনকল্যাণে নিবেদিত আওয়ামী লীগের আলোচনার দুয়ার সবার জন্য উন্মুক্ত।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, জনসাধারণের যেকোনো অংশের সমস্যা-সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ সদা-সচেষ্ট। রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেন। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলগতভাবে বিপুল বিজয়ের পরেও জোটগত অবস্থান বজায় রেখেছে। তিনি বলেন, ‘আপনি যাদের সঙ্গে আপসের কথা বলছেন, তারা তো কোনো রাজনৈতিক দল না। তাদের কিছু বক্তব্য আছে। সেটি তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে তুলে ধরেছে। এর বেশি কিছু না।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আপনার সঙ্গে আমি একমত যে ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং জঙ্গিবাদ একটি উদ্বেগের বিষয়।’ প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে ‘ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং জঙ্গিবাদ’ কী করে সৃষ্টি হলো? দেশবাসী জানে, ২০০১-এর নির্বাচনের পর ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে দেশে ‘ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং জঙ্গিবাদ’-এর সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের কোনো ঠাঁই নাই। বাংলাদেশের মানুষ সহজ-সরল, ধর্মভীরু ও মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু উগ্র না। যেকোনো ধরনের উগ্রতাকে তারা ঘৃণা করে। দেশের সম্মানিত নাগরিকগণ কখনোই জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় নাই। ভবিষ্যতেও দেবে না।’
আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে দেশবাসীকে কেমন নেতৃত্ব দিতে চায়—এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তোফায়েল আহমেদ বলেন, মহান জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধুর চেতনায় সমৃদ্ধ বিজ্ঞানমনস্ক দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব গড়ে তোলাই আওয়ামী লীগের আরাধ্য। যারা ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে’ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এমন সৎ, কর্মঠ, বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতৃত্ব আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হবে বলে আওয়ামী লীগ মনে করে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা বন্ধে এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা কী, এর উত্তরে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমি মনে করি, দেশে বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংবিধানসম্মত নির্বাচন বর্জন করে যে ভুল করেছিলেন, সেই ভুলের মাশুল তাঁরা আজ নিজেরাই গুনছেন। আশা করি, আগামীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। এর মধ্য দিয়েই দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রেখে গণতন্ত্রকে আরও সুসংহত করাই আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা।’