ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। দেশের অনুসৃত উন্মুক্ত অর্থনীতি উপ-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে উইন-উইন অবস্থান তৈরি করে সাফল্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ আড়াই ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হবে এবং জনপ্রতি মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল সংসদ অধিবেশনে টেবিলে উত্থাপিত প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের প্রশ্নের লিখিত উত্তরে প্রধানমন্ত্রী আরো জানান, দেশে শিল্প বিকাশ ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যমান বিনিয়োগ পরিবেশ আরো উন্নত করার লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পে বিভিন্ন পরিসেবা, ভূমির নিশ্চয়তা, প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রদানসহ বিনিয়োগবান্ধব আইন ও নীতিমালা করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেসরকারি খাতকে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি ধরে স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বেসরকারি খাতের উন্নয়নে আর্থিক নীতিনির্ধারণ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গঠনে আমাদের সরকারের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে আমরা ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে আমরা একশত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। যেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হবে। শিল্প- কলকারখানা গড়ে উঠবে এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। তিনি আরো জানান, ২০২১ সালে আইটি সেক্টরে ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান এবং এ সেক্টর থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করার টার্গেট নিয়ে কালিয়াকৈরে ৩৫৫ একর জমির ওপর পিপিপি’র ভিত্তিতে হাই-টেক পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)’র অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। একইভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’র সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যসমূহ ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্জন করে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী এসডিজি বাস্তবায়নেও রোল মডেল হিসেবে পরিচিত হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারসের (পিডব্লিউসি) ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে। যার বর্তমান অবস্থান ৩১তম।
৪৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৩ হাজার মেগাওয়াট: সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মামুনুর রশীদ কিরণের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মে মাস থেকে ২০১৭ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের মেয়াদে দেশে মোট ১৩ হাজার ৫৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে অবসরে যাওয়ার কারণে বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে ১৩ হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ক্যাপটিভসহ ১৫ হাজার ৩৫১ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বিভিন্ন সরকারের মেয়াদে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ায় বিদ্যুতের পরিমাণ তুলে ধরেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ ও ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ পরিকল্পনায় জানুয়ারি ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৬ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
প্রতিবছর দুই লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত: সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে প্রতি বছর ২ লাখেরও বেশি মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, আর এই চিকিৎসাও ব্যয়বহুল, বিশেষ করে দরিদ্র, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য চিকিৎসা ব্যয় কষ্টসাধ্য- কথাটি সত্য। তিনি বলেন, ক্যানসারের ওষুধের বিদেশনির্ভরতা কমাতে এবং উচ্চ মূল্যের ওষুধ সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনার জন্য দেশীয় কোম্পানিগুলোকে ক্যানসারের ওষুধ প্রস্তুতের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। যাতে ওষুধের ক্রয়মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনা যায়। ক্যানসারের চিকিৎসা বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে দেশের পুরাতন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে নতুন রেডিওথেরাপি মেশিন সংযোজনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত থ্রাস্ট সেক্টর: তরিকত ফেডারেশনের সংসদ সদস্য এমএ আউয়ালের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা জানান, বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতকে সরকার থ্রাস্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা করছে। এ খাতের গুরুত্ব অপরিসীম বিবেচনায় সরকার বিদ্যমান শ্রম বাজার ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রম বাজার সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছে। বিগত জোট সরকারের আমলে যেখানে বিশ্বের মাত্র ৯৭টি দেশে কর্মী প্রেরণ করা হতো, সেখানে নতুন আরো ৬৫টি দেশে কর্মী প্রেরণসহ বর্তমানে এই সংখ্যা ১৬২টি দেশে উন্নীত করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। নতুন শ্রম বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহও শ্রমবাজার সম্প্রসারণে কাজ করছে। তিনি জানান, বিশ্বের ১৬২টি দেশে ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত আছেন। বিদেশে যেসব প্রবাসী অবৈধ অবস্থায় আছে তাদেরকে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে বৈধকরণ, আইনি সহায়তা প্রদান এবং দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মানব পাচার প্রতিরোধ, অবৈধ কর্মীদের বৈধতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাসসহ নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
আন্তঃদেশীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্ক: সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মহাসড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়নের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে মহাসড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি জানান, আন্তঃদেশীয় আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ মহাসড়ক নেটওয়ার্ক সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করে। ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধার কারণে ৫টি আন্তঃদেশীয়, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক মহাসড়ক নেটওয়ার্ক উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পৃক্ত। তিনি জানান, ২০১৫ সালের ১৫ই জুন ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে বিবিআইএন স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে চার দেশের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি, যাত্রীবাহী যানবাহন এবং পণ্য পরিবহনের জন্য পণ্যবাহী যান চলাচল করতে পারবে। ইতিমধ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল চুক্তিটি অনুসমর্থন করেছে। আশা করা যায়, ভুটানও সহসাই চুক্তিটি অনুসমর্থন করবে। চার দেশের অনুসমর্থনের পর চুক্তিটি বাস্তবায়ন হবে।