গত পাঁচ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্কলারশিপ কমিটিতে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে | বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমার কাজ ছিল আবেদনকারী ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রছাত্রীদের একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা | সেই তালিকা থেকেই অনেক যাচাই বাচাই করে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা হতো | অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ হতো | সেখান থেকেই বাছাই করা নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপের জন্য ইনভাইটেশন লেটার পাঠানো হতো | তবে বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের সিভি, ট্রানসক্রিপ্ট, রিকোমেন্ডেশন লেটার এগুলো পড়ে, দেখে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে | তা ছাড়া আমার নিজের ল্যাবেও কিছু বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী নিয়োগ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে | এই অভিজ্ঞতাগুলোর কিছু অংশ স্কলারশিপ প্রার্থী ছাত্রছাত্রীদের কাজে আসতে পারে |
দুই.
অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডির ভর্তি এবং স্কলারশিপের জন্য যারা অ্যাপ্লাই করেন, তাদের অ্যাপ্লিকেশন প্রথমেই তারা কোন দেশ থেকে এসেছেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছেন, তাদের এডুকেশন লেভেল অস্ট্রেলিয়ার এডুকেশন লেভেলের সমান কিনা—তার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোনো দেশের এডুকেশন লেভেল অস্ট্রেলিয়ার এডুকেশন লেভেলের সমান না হয়, তাহলে সে দেশের মাস্টার্স ডিগ্রিধারী একজন ছাত্র তার দেশের মাস্টার্স ডিগ্রি ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়াতে সরাসরি পিএইচডিতে ভর্তি ও স্কলারশিপের সুযোগ পাবেন না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি কেমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ তা একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করি। অস্ট্রেলিয়া কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্কের অধীনের এক নীতিমালায় অস্ট্রেলিয়া সরকার বাংলাদেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনটি ভাগে ভাগ করেছে।
সেকশন ১: মূলত ১৯৭১ সালের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত সকল বিশ্ববিদ্যালয় এই সেকশনের অধীনে আছে। প্রথম ক্যাটাগরিতে রাখার কারণ হিসেবে দুটি বিষয়কে বিবেচনায় আনা হয়েছে। (ক) কোয়ালিফায়েড শিক্ষক, যাঁরা ভালো মানের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম নিশ্চিত করেন। (খ) প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষা। যার মাধ্যমে দেশ সেরা ছাত্রছাত্রীদের এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কুয়েট, চুয়েট, ডুয়েট, রুয়েট, কৃষি, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এই সেকশনে স্থান পেয়েছে।
সেকশন ২: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের সকল কলেজ এই সেকশনে পড়েছে। এখানে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধীনস্থ সকল কলেজের শিক্ষামান স্ট্যান্ডার্ড মানের অনেক নিচে। এই সব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের এমপ্লয়মেন্ট আউটকামস ন্যাশনাল লেভেলে তেমন ভালো হয় না। এই সব কলেজের বেশির ভাগ শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগের বিএসসি বা এমএসসির চেয়ে বেশি উচ্চতর কোনো ডিগ্রি নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে আনা মারাত্মক সমস্যাগুলোকে এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। কলেজের পাশাপাশি এই সেকশনে আরও রাখা হয়েছে দেশের প্রায় সবগুলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে (ফেনী, বরিশাল, কুমিল্লা, যশোর, পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাকি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়)। খুব অবাক হয়ে আমি খেয়াল করেছি এই সেকশনে ফেলে রাখা হয়েছে দেশের সেরা দুটি বিশ্ববিদ্যালয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে (খুবি)!
সেকশন ৩: ওপরের দুই সেকশনের বাইরে যত প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় সবগুলো এই সেকশনের অধীনে আছে।
এই রকম সেকশনে ভাগ করে যা করা হয়েছে তা বিস্তারিত বোঝাতে নিচে দুটি উদাহরণ দিচ্ছি |
সেকশন ১-এর অধীনের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন ছাত্র বা ছাত্রী যদি চার বছরের ব্যাচেলর পাস করার পর দুই বছরের মাস্টার্স করে, তবে তার এই দুটি ডিগ্রিকেই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাচেলর ও মাস্টার্সের সমপর্যায়ের বলে ধরা হবে। অর্থাৎ এই ছাত্র বা ছাত্রীর পক্ষে বাংলাদেশে মাস্টার্স করে অস্ট্রেলিয়ার যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য সরাসরি অ্যাপ্লাই করতে পারবে।
সেকশন ২-এর লিস্টেড বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যদি কেউ চার বছরের (অনার্স) ব্যাচেলর করে তবে তার ডিগ্রি অস্ট্রেলিয়ার মূল ব্যাচেলর ডিগ্রির অ্যাসোসিয়েট বলে ধরা হবে। দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রিকেও অস্ট্রেলিয়ার মূল মাস্টার্স ডিগ্রির অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি ভাবা হবে। এই ছাত্র বা ছাত্রী যদি চার বছরের (অনার্স) ব্যাচেলরের পরে আবার দুই বছরের মাস্টার্স করে তবে তার যোগ্যতাকে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাচেলরের সমপর্যায়ের ভাবা হয় (তাও থিসিস ও ডিগ্রির মূল্যায়ন সাপেক্ষে)। তার মানে সেকশন ২-এর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের অনার্স ও দুই বছরের মাস্টার্সের পর অস্ট্রেলিয়াতে কেউ সরাসরি পিএইচডি করতে পারবে না। এমনকি মাস্টার্সে অ্যাপ্লাই করলেও সেটা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে বলা যাবে যে, সেই ছাত্র বা ছাত্রী আসলে মাস্টার্সে ভর্তি হতে পারবে কি না!
আমি কখনো ইনস্টিটিউটের ক্লাসিফিকেশনে বিশ্বাস করি না। কোন ইউনিভার্সিটি ভালো আর কোন ইউনিভার্সিটি খারাপ—এটি আমি সহজে বলতে পারি না। কারণ পুরো বিষয়টিই আমার কাছে আপেক্ষিক বলে মনে হয়। কিন্তু এর পরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাংলাদেশের অন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাবিপ্রবি ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান খারাপ—এটি আমি মেনে নিতে পারব না। ওখানে ভালো মানের শিক্ষক নেই সেটিও মেনে নিতে পারব না। আমার জানা মতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেক ছাত্রছাত্রী অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন ও মূলধারার গবেষণা করছেন। যেকোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে শাবিপ্রবি থেকে বেশি বই কম জার্নাল পেপার হয় না। পত্রিকায় তো দেখি প্রায় প্রতি বছরই শাবিপ্রবির কোনো না কোনো শিক্ষক ইউজিসির গবেষণা এক্সসেলেন্স পুরস্কার পান।
সংগত কারণেই আমি এখানে একটি অনুরোধ করতে চাই | আমাদের শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ কী এই ব্যাপারে ইউজিসির সঙ্গে বা শাবিপ্রবি-খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলাপ করবেন? আমরা যারা এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রী আনতে চাই তাদেরও উপকার হয়, ওই সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রীরাও ঝামেলা থেকে মুক্তি পান।