প্রশ্নটাই অবান্তর। সেটি দুই কারণে। প্রথম কারণ, ক্রিকেটে ‘কী হলে কী হতো’ আলোচনা শুরু করলে সেটি শেষ হওয়ার নয়! আর দ্বিতীয় কারণ, রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলির ওই ব্যাটিং। যা তিন শ-ও ভারতের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ হতো বলে মনে করতে দিল না।
সেটি তো পরের কথা। এর আগে এই ম্যাচের অনেকটা সময়জুড়ে ওই ‘তিন শ’ সংখ্যাটাই কিন্তু বারবার উচ্চারিত হলো। ভারতীয়রা সেটি বলার সময় তাতে মিশে থাকল স্বস্তি। বাংলাদেশিদের আলোচনায় ‘তিন শ’ এক আক্ষেপের নাম। যা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি।
এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশের ম্যাচ মানেই গ্যালারিতে অসংখ্য লাল-সবুজ জার্সি। কিন্তু ভারতীয়দের সঙ্গে কি আর পারা
যায় নাকি! এজবাস্টনের গ্যালারিতে কাল তাই যথারীতি তেরঙ্গা-ই বেশি। কেউ ঢোল নিয়ে এসেছে, কেউ বা কাঁসর। দুই ইনিংসের বিরতির সময় সেসব সহযোগে ভারতীয় সমর্থকদের একটা দল এজবাস্টনের মূল ভবনের লাগোয়া জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ‘জিতেগা গো জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা’ বলে চিৎকার করছিল। মাঠে কথা বলে কমেন্ট্রি বক্সে ফিরছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। তাঁকে দেখামাত্র চিৎকারটা বদলে গেল ‘ইন্ডিয়া জিত গিয়া’-তে।
ভারতের ইনিংস শুরু হতে তখনো মিনিট বিশেক বাকি। তখনই ম্যাচ জিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে ফেলার মূলেও ওই ‘তিন শ’। বাংলাদেশের যা করার কথা ছিল, কিন্তু করতে পারেনি। ‘করার কথা ছিল’ মানে কী? ক্রিকেটে কি কোনো কিছুর নিশ্চয়তা আছে নাকি! নেই বলেই বাংলাদেশের স্কোর ৭ উইকেটে ২৬৪। এই উইকেটে ভারতের এই ব্যাটিং লাইনআপের জন্য যা কোনো চ্যালেঞ্জই নয়। ম্যাচের অর্ধেক বাকি থাকতেই ভারতীয় সমর্থকেরা ভারতের জয়ের ঘোষণা দিয়ে ফেলার সাহস পেল তো এ কারণেই।
শেষ পর্যন্ত হলোও তা-ই। শিখর ধাওয়ানের সঙ্গে রোহিত শর্মার ৮৭ রানের উদ্বোধনী জুটি। বিরাট কোহলির সঙ্গে ১৭৮ রানের পরের জুটিটা তো ম্যাচ শেষ করে দিল। মেলবোর্নের ওই বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে আউট হয়েও আম্পায়ারের বিতর্কিত ‘নো’ বল ডাকার কল্যাণে সেঞ্চুরি করে ম্যাচটা বের করে নিয়েছিলেন রোহিত শর্মা। কালকের সেঞ্চুরিতে কোনো বিতর্ক নেই। তাঁর ১২৩ রানের ইনিংসটি উল্টো প্রশ্ন তুলে দিল, বাংলাদেশ তিন শ পেরোনো স্কোর করলেও কি কোনো লাভ হতো? ৯.৫ ওভার বাকি থাকতেই ৯ উইকেটে জয়। তিন শ বিশ-ত্রিশেও তো মনে হয় কাজ হতো না। নাকি তখন খেলাটা অন্য রকম হতো!
ওই স্কোরটাও কিন্তু একসময় অসম্ভব মনে হচ্ছিল না। ওয়ানডেতে একটা অলিখিত সূত্র আছে। যেটি বলে, হাতে উইকেট থাকলে ৩০ ওভারের স্কোরকে দ্বিগুণ করা যায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশের স্কোর হওয়ার কথা ৩২২! কারণ ৩০ ওভারে বাংলাদেশ করে ফেলেছিল ১৬১ রান। হাতে তখনো ৭ উইকেট। কিন্তু যা হওয়ার কথা, সব সময় তা-ই হলে খেলার কি আর মজা থাকত! বাংলাদেশও যেমন ৩০ ওভারের স্কোর দ্বিগুণ করা দূরে থাক, ২৫ ওভারের স্কোরও দ্বিগুণ করতে পারল না। প্রথম ২৫ ওভারে ২ উইকেটে ১৪২ রান, পরের ২৫ ওভারে ১২২। সেমিফাইনালের বাকি অর্ধেকটাকে যা অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা বানিয়ে দিল।
বাংলাদেশের ইনিংসে পরিষ্কার দুটি ভাগ—কেদার যাদব বোলিংয়ে আসার আগে ও পরে। মূলত ব্যাটসম্যান, একটু-আধটু অফ স্পিনও পারেন। বিচিত্র সেই অফ স্পিন। বল বলতে গেলে টার্নই করে না, একেবারেই আস্তে আসে। ব্যাটসম্যানের বিরক্তি উৎপাদনের জন্য আদর্শ রেসিপি। এই বোলিং দিয়েই সেমিফাইনালের রং বদলে দিলেন কেদার যাদব।
২৬তম ওভারে বোলিংয়ে এসেছেন। তামিম ও মুশফিকের তৃতীয় উইকেট জুটিতে তখন ‘সেঞ্চুরি’ হয়ে গেছে। দুজনই এমন খেলছেন যে, তিন শ পেরিয়ে বাংলাদেশ আরও কত দূর যেতে পারে, আলোচনা হচ্ছে এ নিয়ে। ভারতের বিপক্ষে এর আগে একবারই তিন শ করেছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে মিরপুরের ওই ম্যাচেই ওয়ানডের পৃথিবীতে মোস্তাফিজুরের আবির্ভাব। বাংলাদেশ করেছিল ৩০৭। মোস্তাফিজুর ৫ উইকেট নিয়ে এর ৭৯ রান দূরেই থামিয়ে দিয়েছিলেন ভারতকে।
এখনো যে ওই ৩০৭-ই ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ হয়ে রইল, সেটির কারণ ইনিংসের মাঝখানে ৪৫টি বল। যাতে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের তিন স্তম্ভই ভেঙে পড়ল। যাদবকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে তামিম বল স্টাম্পে নিয়ে গেলেন। মুশফিক এগিয়ে গিয়ে ফুলটস বানিয়ে ফ্লিক করলেন, সেটি চলে গেল মিড উইকেটে কোহলির হাতে। ১৩৪ বলে ১২৩ রানের জুটির দুই অংশীদারের বিদায়ের মাঝখানে সাকিবও আউট হয়ে গেছেন। জাদেজার বলে কাট করতে গিয়ে কট বিহাইন্ড।
প্রকৃতির কল্যাণে পাওয়া সুযোগটা হেলায় হারানোটা নিশ্চিত হয়ে গেছে এতেই। এজবাস্টনের এই উইকেটে টসে জিতে যেকোনো দলের চোখ বুজে ব্যাটিং করার কথা। বিরাট কোহলি তারপরও যে বাংলাদেশকে ব্যাটিং করতে পাঠালেন, সেটির সম্ভাব্য কারণ হতে পারে একটাই, ম্যাচ শুরুর নির্ধারিত সময়ের আধঘণ্টা আগে শুরু হওয়া ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। যে কারণে ম্যাচ শুরু হলো ১০ মিনিট পর। ঝিরিঝিরি থেকে ইলশেগুঁড়ি হয়ে তখনো বৃষ্টি ঝরে চলেছে, আকাশ এমন মুখ কালো করে আছে যে, সকালবেলায়ই ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে দিতে হয়েছে। ইংলিশ কন্ডিশন বলতে যা বোঝায়, ঠিক তা-ই।
সেটি অবশ্য খুব বেশিক্ষণ থাকেনি। ঝলমলে রোদ উঠেছে। এজবাস্টনের রানে ভরা উইকেট ব্যাটসম্যানদের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করেছে। তামিম আর মুশফিকের ব্যাটিং দেখে কোহলি নির্ঘাত আফসোস করতে শুরু করেছেন, কেন বাংলাদেশকে আগে ব্যাটিং করতে দিলেন!
সেই আফসোস মিলিয়ে দেওয়ার কাজটি করলেন কিনা কেদার যাদব! ক্রিকেট কখনো কখনো সত্যিই খুব বিচিত্র!