কলকাতার এক অধুনা-অভিজাত প্রযুক্তি-কলেজ। এখানে মিডিয়া সায়েন্স বলে একটা পদার্থ পড়ানো হয়, যেখানে ফিল্ম স্টাডিজ বলে একটা পেপার রয়েছে। সেই পেপারের আবার আর এক বিভাজন ভারতীয় সিনেমা। সাম্প্রতিক প্রজন্মের কাছে এই অংশটি পড়াতে যাওয়া একটা দিক্কত বটে! ১৮-২১ বছরের সুকুমারমতিরা কিছুতেই সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক দেখতে রাজি নয়। একাংশের বক্তব্য, দেখা যায় না। কারণ, এই সব ছবি এইচডি নয়। অন্য অংশ কিছু বলতে চায় না। অনেক টেপাটিপি করে যে পেস্ট বেরোয়, তার সারাংশ, এগুলো একেবারেই ফিলগুড নয়। দেখলে মেজাজ খিঁচড়ে যায়। তা সেই খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজ-সম্পন্ন জেন-ওয়াই কে বাধ্য করা হয়েছিল যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো দেখতে। এসি ক্লাস রুমের আমেজ, দুপুরের সন্নাটা ইত্যাদি ঘুমের আয়োজনের মাঝখানে অতি কষ্টে পুঙ্গবরা সেই ছবি দেখলেন এবং, শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন রাখলেন, স্যর, ওই জঙ্গলের মালগুলো কারা? ওরা কি মাওবাদি?
ডাউন দ্য মেমরি লেন। ১৯৭০-এর দশককে যাঁরা মুক্তির দশক-এ রূপান্তরিত করতে চেয়ে পাইপগানের নল কতটা গরম হয়ে যায় পরীক্ষা করতে চেয়েছিল যে প্রজন্ম, নয় নয় করে তাঁদের অনেকেই আজ বহাল তবিয়াতে বর্তমান। কেউ হাই কর্পোরেট, কেউ সেলিব্রিটি জার্নালিস্ট, কেউ আবার অ্যাকাডেমিয়ার শাসনকর্তা। আবার এঁদের মধ্যেকার কেউ একেবারেই ফ্যাতাড়ু। পাড়ার চায়ের দোকানে নীরবে বসে অন্যের বাতেলা শোনেন। জেন-জেড এঁদের চেনে না। কানের কাছে নকশাল শব্দটা উচ্চারণ করলে বোকাছেলে পুচু পুচু হয়ে তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ জানে, একদিন এই দেশে একটা যুদ্ধু হয়েছিল। তাতে নকশাল বলে একটা প্রাণী ছিল। তারা ডাইনোসর না ওয়্যারউলফ, সেটা তারা কিছুতেই বলতে পারবে না। কারণ তারা সিলেবাসে নেই।
আজ পঞ্চাশ বছর বাদে খাতা খুলে যদি খোঁজ নেওয়া যায়, তবে দেখা যাবে, নকশাল আর মাওবাদী— এই শব্দ দুটি সমার্থক। এদের মহিমা এক ও অভিন্ন। ১৯৭০-এ মাও থাকলেও মাওবাদী ছিল না, একথা কে তাদের বোঝাবে! তা ছাড়া মাও বস্তুটা খায় না মাথায় মাখে, তা নিয়েও তারা কনফিউজড। এর আরও বড় কারণ এই সব ঘপলঘুট্টি সিলেবাসে নেই। সরকারি সিলেবাসে গত ৫০ বছরের ইতিহাস কেন ইনক্লুডেড হল না, তা নিয়ে সারগর্ভ নিবন্ধ লেখার সামর্থ্য বর্তমান মুসাবিদাকারীর নেই। সেই লেখার দায়িত্ব যাঁরা নিতে পারতেন, তাঁরা ফেলোশিপ আর গ্রান্টের চক্করে এসবে হাত দিতে পারেননি। ফলে যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। পঞ্চাশ বছর আগেকার বিষয় আজ অধরা মাধুরী হয়ে কোথায় লা পতা! কথা অধিক হলে তিক্ত লাগে। সেই অনুষঙ্গেই চুপ থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সমস্যা একটাই, কোনওদিন যদি নব্যপ্রজন্ম ঋত্বিকের যুক্তি, তক্কো… অথবা তপন সিংহের রাজা দেখে প্রশ্ন করে বসে— ওরা কারা?
পাড়ার মোড়ে যেখানে ভোডাফোনের মুখপাত্ররা বাগান-ছাতা খুলে সিম বেচেন, তার ঠিক পিছনেই একটা শহিদ বেদি। গায়ে লেখা ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাতো ঝড়। তলায় বরানগর আর বারাসাতের সালতামামি। ভোডাফোনের ছাতা পেরিয়ে ততদূর নজর যায় না। কিন্তু যদি যায়, কী বলা হবে তখন? কারা ওরা? কেমন বীর? বাহুবলীর মতো? এই সব প্রশ্নে চাপা পড়ে থাকে কাল-মহাকাল-ত্রিকাল। ৩৪ বছরের বামন শাসনে নকশাল শব্দটাকে মুছে দেওয়ার যে প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল, তার লিগ্যসি আজও বহমান। এমন নয়, নকশাল আন্দোলনকে এক বিরাট লাল সেলাম জানানোর দরকার। এমন নয়, নকশালপন্থীদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে একাসনে বসানোর দাবি তোলা হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতকে জানার অধিকারটা তো থাকবে! সব দোষ যে সিলেবাস-ওয়ালা গভর্নমেন্টের, তা নয়। সরকারি ইতিহাসের বাইরে কি সাহিত্য আর সিনেমার মতো পপুলার মিডিয়া নকশাল আন্দোলনকে তুলে ধরেনি গত ৫০ বছরে? সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইন দ্য ওয়েক অফ নকশালবাড়ি বা মৃদুল দাশগুপ্তের কাব্যগ্রন্থ জলপাইকাঠের এস্রাজ-এর মতো হাই কালচারাল বইতে হাত দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম, সমরেশ মজুমদারের কালবেলা তো হাতের কাছেই ছিল। ঋত্বিক-তপন সিংহ মাথায় থাকুন, সুমন মুখোপাধ্যায়ের হারবার্ট, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মেঘে ঢাকা তারা-ও তো ছিল। গোবিন্দ নিহালনির হাজার চৌরাশি কি মা অথবা সুধীর মিশ্রর হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যায়সি ছিল। তবু এই বিস্মৃতির কারণ কী?
এর পিছনে কি গত ৩০ বছরের ডিপলিটিসাইজেশন? বিরাজনৈতিকীকরণের নিজস্ব রাজনীতিতেই কি হারালো ৫০ বছর আগেকার ইতিহাস? নাকি গ্লোবাল পরিসরে নকশাল শব্দটার হার্মেনিউটিক ঘেঁটে ঘ হয়ে গিয়েছে? এইসব প্রশ্নের জবাব হাতের কাছে নেই। বরং তথাকথিত প্রি-গ্লোবাল কাল পর্বে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। সুমন চট্টোপাধ্যায় নামক এক গায়ক ছিলেন তখন পশ্চিমবঙ্গে। তাঁর গানের গোড়াতেই ছিল এই স্মৃতিরেখা। একে সম্বল করেই সারা রাত জেগে আঁকা লড়াকু ছবির মানে বুঝতে পেরেছে ১৯৭৭-৭৮-এ জন্মানো প্রজন্ম। অসুবিধে হয়নি কোথাও। কিন্তু ১৯৯০-২০০০-এর মধ্যে জন্মানো প্রজন্মের কাছে কি এক ন্যাড়া মাথা বৃদ্ধের কোনও আবেদন রয়েছে? প্রৌঢ়রা স্মৃতি কণ্ডুয়ণ করে বেঁচে থাকেন। তরুণের সেই দায় নেই। কিন্তু তাই বলে কোনও দায়ই কি নেই?
পাড়ার লোকাল কমিটির আপিসের বাইরের বেঞ্চে বসে বতাদা মুড়ি চিবোন। ফোকলা দাঁত, পকেটে রাখা রয়েছে বাঁধানোটা। মাথার কাছে পোকায় কাটা কার্ল মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন। সেদিনের কথা শোনানোর পাবলিক পাওয়া যায় না। পাশ দিয়ে ঝাঁ ঝাঁ বেরিয়ে যায় বাইক। বতাদা হাসেন। মার্কসও হাসেন বোধ হয়। কী এসে যায়! এই তো খবরের কাগজে উঠে এসেছে নকশালবাড়ি। অমিত শাহ আর শ্রীরাম বাহিনী সেখানে ডাক দিলেন আন্দোলনের। পঞ্চাশ বছর পরে আবার জেগে উঠলেন চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল। পতাকার রং বদলে দিয়েছে। জনতার আফিমে গেরুয়া পাক লেগেছে। তো কী হয়েছে! সশস্ত্র আন্দোলন তো শুরু হয়েই গিয়েছে রামনবমীর দিন। এখন টাইম জমি দখলের। সারা পশ্চিমবঙ্গ! বন্দুকের নল কি সত্যিই ক্ষমতার উৎস? চিনের চেয়ারম্যান কি প্রকৃতই আমাদের চেয়ারম্যান? ডেবরা-গোপীবল্লভপুরে কৃষক গেরিলাদের সঙ্গে জোতদারের মুন্ডু নিয়ে গেন্ডুয়া খেলায় কে জিতল, কে হারল? এই সব প্রশ্নের উত্তর জানা হল না পঞ্চাশ বছরে। বতাদা এমএল করতেন। আজ সিপিএম। ১৯৭৮-এ শেলটার নিয়েছিলেন। তৃণমূল হতে পারেননি। পারবেন বলেও মনে হয় না। তাতে কিস্যু যায় বা আসে না এইচডি আর ফিলগুড-দের। এই অবসরে নকশালরা পল্লবিত হতে থাকুন নচিকেতা চক্রবর্তীর অনির্বাণ-এর মতো ধরি মাছ না ছুঁই পানি-মার্কা গানে। পল্লবিত হতে থাকুন মাওবাদিদের সঙ্গে কনফিউশনে।
সূত্র: অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়, এবেলা.ইন