পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার রাজ্যের ‘স্বার্থে’ তিস্তার জল বণ্টনে অনড় থাকলেও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ছিটমহল বিনিময়ে রাজি হয়েছেন।
অবশেষে আপত্তি তুলে নিলেন তিনি। মূলত ছিটমহলবাসীদের আন্দোলনের চাপেই নরম হলেন মমতা। তবে তা শর্তের জালে আটকা রয়েছে।
ওই শর্ত পূরণ হলেই ছিটমহলবাসীদের দীর্ঘদিনের মানবেতর জীবনযাপনের অবসান হবে। অন্ধকার ঘুচে আসবে আলো।
বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও পঞ্চগড়ে ভারতের ১১১টি ছিটমহল রয়েছে। ১৭ হাজার ১৫৮ একর জায়গা নিয়ে এসব ছিটমহলে বর্তমানে ৩৭ হাজার ৩৬৯ জনের বসবাস।
অন্যদিকে, ভারতীয় ভূখণ্ডে বাংলাদেশি ছিটমহল রয়েছে ৫১টি। সব কটিই পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায়। সাত হাজার ১১০ একর জায়গাজুড়ে ওই ছিটমহলগুলোতে বাসিন্দা রয়েছে ১৪ হাজার ২১৫ জন। উভয় দেশের এই ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা দীর্ঘকাল ধরে মানবেতর জীবন যাপন করে আসছে। শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত এসব ছিটমহলের বাসিন্দারা। জ্বলে বিদ্যুতের আলো। এই মানবেতর অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনও করে আসছে ছিটমহলের বাসিন্দারা।
অবশেষে এসব ছিটমহল বিনিমসয়ের উদ্যোগ নেয় দুদেশের সরকার। কিন্তু অভিন্ন নদী তিস্তার জলবণ্টনের মতো আটকে যায় বিছিন্ন ওইসব জনপদের মানুষের ভাগ্যও।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় ছিটমহল বিনিময়ের পথ সুগম করতে দুদেশের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমান্ত চুক্তির আলোকে নতুন করে প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়।
কিন্তু স্থলসীমান্ত চুক্তি ও এর আওতায় স্বাক্ষরিত প্রটোকল বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধনের বিল ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় উত্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হলেও মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস, আসাম গণপরিষদ (এজিপি) ও বিজেপির বিরোধিতায় তা আটকে যায়।
এর পর অবশ্য একবার মমতা তার সম্মতি প্রকাশ করেছেন। চলতি বছরের জুন মাসে শিলিগুড়িতে এক বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার সম্মতির কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘অন্য পক্ষ থেকে’ সমস্যা না থাকলে দুই দেশের ছিটমহল বিনিময়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজি।’ ওই সময় হিন্দুস্থান টাইমসে এ খবর প্রকাশ হয়। তবে অন্যপক্ষ বলতে কি বোঝানো হয়েছে তা বলা হয়নি ওই প্রতিবেদনে। এবার শর্তসাপেক্ষে হলেও অনড় অবস্থান থেকে সড়ে এসেছেন মমতা।
মমতা ছিটমহল বিনিময় চান। তবে বিনিময়ের ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে ওই চুক্তি করতে হবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারকেই ওই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মমতার দাবি, রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলে সেই ক্ষতিপূরণ চূড়ান্ত করতে হবে।
মমতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করেননি। তবে, বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশে চলে যাওয়া ভারতীয় ছিটমহলের যে বাসিন্দারা ওইদেশে দেশে চলে যেতে চাইবেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথাই তিনি বলেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথম থেকেই ভারতীয় ছিটমহলের অধিকাংশ বাসিন্দা বাংলাদেশের নাগরিক হতে আগ্রহী নন।
মমতার এই অবস্থান পরিবর্তনে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়ায় যে বড় বাধা ছিল সেটা দূর হলো।
এর আগে শেষমুহূর্তে তার বাধাতেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকায় গিয়েও বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলচুক্তি ও তিস্তা নদীর জলবণ্টন চুক্তি না করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাতে দুদেশের সম্পর্কে সামান্য হলেও চিড় ধরেছিল। অস্বস্তিতে পড়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
ওই ব্যর্থতার দায় সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে আন্দোলনে নামে বিএনপি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণি পরে কলকাতায় গিয়েও মমতার মন গলাতে পারেননি।
সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এবার তার আপত্তি তুলে নিলেন। এখন কেন্দ্রীয় সরকার অসমের বিজেপি নেতাদের রাজি করাতে পারলেই সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরে আর কোনো বাধা থাকবে না। এ চুক্তি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও আপত্তি ছিল বিজেপির। বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারের মসনদে আসীন হওয়ার পর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ ব্যাপারে সুর একটু নরম করে। কিন্তু দলের অসমের নেতারা এ নিয়ে আপত্তি জানান। তাদের যুক্তি, ছিটমহল বিনিময়ের ফলে অসমের প্রচুর জমি বাংলাদেশে চলে আসবে।
বিনিময়ে ভারত যা পাবে, তার আয়তন তুলনায় অনেক কম। সীমান্ত চুক্তি করতে হলে বাংলাদেশকে সমপরিমাণ জমি অসমকে দেয়ার দাবিও তোলেন ওই রাজ্যের বিজেপি নেতারা। ইউপিএ আমলে বিরোধী নেত্রী সুষমা স্বরাজ বারবার এই যুক্তিতেই চুক্তির বিরেধিতা করেছিলেন।
কঠিন মমতা কেন হঠাৎ নরম হলেন সে ব্যাখ্যা তিনি নিজেই দিয়েছেন। গতকাল সোমবার দিল্লিতে সংবাদমাধ্যমকে মমতা বলেন, ‘ছিটমহল বিনিময়ে স্থানীয় লোকেদের আপত্তি না থাকলে, আমার আপত্তি থাকার কথা নয়। আমরা সমীক্ষা করে দেখেছি, স্থানীয় লোকের আপত্তি নেই। তারা কেবল উপযুক্ত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ চাইছেন।’
উল্লেখ্য, মমতার আপত্তিতে সীমান্ত চুক্তি আটকে যাওয়ার কারণে ছিটিমহল বিনিময় না হওয়ায় এতদিন হতাশায় ছিলেন ছিটমহলের বাসিন্দারা।
তারা এ নিয়ে লাগাতার আন্দোলনও করেছেন। অব্যাহতভাবে চাপ সৃষ্টি করেছেন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। মমতা সেই বাস্তবতা তার দল এবং রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে বুঝতে পেরেছেন। এর পরই অবস্থান পরিবর্তমন করেন বলে মনে করা হচ্ছে।
অব্যাহতভাবে চলে আসা এই আন্দোলনের চাপেই অনড় অবস্থান থেকে সরে এলেন মমতা ছিটমহল বিনিময়ে রাজি মমতা
তবে ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে মমতা একদমই অনড়। সাংবাদিকদের সঙ্গে মমতার গতকালের ওই আলোচনায় তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যাপারে একতরফা কথা হয়েছে। কিন্তু এভাবে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে বুলডোজ করে একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।’
মমতার এই নমনীয়তাকে স্বাগত জানিয়েছে ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে আন্দোলনরত ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় দাবি সমন্বয় সমিতি।
তবে ছিটমহল ইউনাইটেড কাউন্সিল নামে অপর একটি সংগঠন বলছে উল্টো কথা। ‘ঢালাওভাবে’ ছিটমহল বিনিময়ের বিরোধী তারা। বড় ছিটমহলগুলো বিনিময় না করে করিডোর তৈরির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের দাবি করছেন তারা।
তাতে ছিটমহলবাসীর স্বার্থ সার্বিকভাবে সুরক্ষিত হবে বলে তাদের দাবি। মুখ্যমন্ত্রী আপত্তি তুলে নিলেও চুক্তি করা অত সহজ হবে বলে মনে করেন না সংগঠনটির নেতারা।