মাত্র এক দিন বয়সে আয়েশা আক্তারকে নিজেদের কাছে নিয়ে এসেছিলেন নিঃসন্তান দম্পতি হযরত আলী ও হালিমা বেগম। গত আট বছরে এক দিনের জন্যও মেয়েকে কাছছাড়া করেননি। সেই মেয়েকে সুরক্ষা দিতে না পেরে আত্মঘাতী হলেন বাবা।
গত শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শ্রীপুর রেলস্টেশনের পশু হাসপাতাল-সংলগ্ন এলাকায় দেওয়ানগঞ্জগামী তিস্তা ট্রেনের নিচে কাটা পড়েন হযরত আলী (৪৫) ও তাঁর মেয়ে আয়েশা আক্তার (৮)। পরিবার বলছে, হযরত আলী মেয়েকে নিয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন।
গতকাল রোববার গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় কথা বলেন হালিমা বেগম। কান্না থামাতে পারছিলেন না সব হারানো ওই নারী। থানায় বসে তিনি তাঁর স্বামী-সন্তান হারানোর কাহিনি বলছিলেন। ওই কাহিনির পরতে পরতে ছিল সমাজ, স্থানীয় সরকার আর পুলিশ প্রশাসনের উপেক্ষার কথা।
হালিমা বলছিলেন, তাঁদের ৮ বছরের মেয়েটি হেরাপটকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। আয়েশা প্রায়ই অভিযোগ করত স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক হোসেনের (২২) নামে। ফারুক তাকে জোর করে সাইকেলে ওঠাত। জঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে চাইত জোর করে। বেশ কয়েকবার একই অভিযোগ করায় হযরত আলী গিয়েছিলেন ফারুক হোসেনের বাবা ফজলু মিয়ার কাছে। কোনো প্রতিকার তিনি পাননি। অনেকটা নিরুপায় হয়েই পরে তিনি গোসিংগা ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য এবং ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য আবুল হোসেন ব্যাপারীর কাছে যান। তিনিও বিচার করেননি। পাগল বলে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন হযরত আলীকে। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যের কাছে অভিযোগ করায় ফারুক হোসেন জোর করে হযরত আলীর গরু নিয়ে যান। এ ঘটনারও বিচার হয়নি। শেষ পর্যন্ত গত ৪ এপ্রিল হযরত আলী শ্রীপুর থানায় অভিযোগ করেন। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। বিচার না পাওয়ায় কষ্ট পেয়েছিলেন হযরত আলী। ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। বেঁচে থেকেও সন্তানকে নিরাপত্তা দিতে না পারায় বিপন্ন বোধ করেছিলেন।
তবে হালিমা আক্তার একবারও ভাবতে পারেননি মেয়েকে সঙ্গে করে বাবা মরতে যাচ্ছেন। সকালবেলা নাশতা করে মেয়ের হাত ধরে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন হযরত আলী। ঘণ্টা দেড়েকের ব্যবধানে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শোনেন স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর খবর।
হযরত আলীদের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কর্ণপুর গ্রামে। লোকের অভাবে বাড়ি খাঁ খাঁ করছিল কাল। প্রতিবেশী মাজেদা বেগম বলেন, ফারুক হোসেন শিশু আয়েশাকে উত্ত্যক্ত করতেন এ কথা তাঁরা আগেও শুনেছেন। তিনি নিজেই মেয়েটির পায়ে আঘাতের চিহ্ন ও ব্যান্ডেজ দেখেছিলেন। কী করে পা কাটল জানতে চাইলে আয়েশার বাবা-মা সে সময় জানিয়েছিলেন, ফারুক হোসেন জোর করে সাইকেলে তোলার চেষ্টা করছিলেন। সাইকেলের চেইনে আটকে আয়েশার পা মারাত্মকভাবে কেটে যায়।
প্রতিবেশীরা বলছিলেন, সে সময় যদি স্থানীয় প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, পুলিশ এগিয়ে আসত, তাহলে হয়তো এভাবে বাবা-মেয়ের প্রাণ যেত না। বাবা ও মেয়ের এই আত্মহত্যার দায় কার? এই দায় ত্রীপক্ষীয় না কি দ্বিপক্ষীয়? যদি ন্যায় বিচার করা হয় তবে, ফারুক হোসেন, ইউপি মেম্বার ও সংশ্লিষ্ট পুলিশকে বিবাদী করা উচিত। তবে জীবদ্দশায় যে বিচার পেল না মৃত্যুর পর কি পাবে বা পাবে না তা নয়, কারণ হতভাগা বাবা-মা তো আর ফিরে আসবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হালিমা বেগমের অভিযোগের ভিত্তিতে দুবার তাঁর বাড়িতে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। ঘটনার পর আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবুল হোসেন ব্যাপারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে যে ফারুক হোসেনের বিরুদ্ধে ৮ বছরের শিশুকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ, তিনি এখন পলাতক।
টঙ্গী রেলওয়ে ফাঁড়ির উপপরিদর্শক সাইফুল ইসলাম বলেন, হালিমা বেগম ফারুক হোসেনসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওই ছয়জনের মধ্যে শুধু ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আবুল হোসেন ব্যাপারী ছাড়া সবাই পলাতক।
বাবা-মেয়ের আত্মঘাতী হওয়ার খবর নাড়া দিয়েছে সবাইকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও চলছে আলোচনা। শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোকেয়া রহমান বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। বিপদে পড়ে অনেক মানুষ তাঁদের কাছে আসেন। কিন্তু হযরত আলী আসেননি। এ ঘটনার পর হালিমা বেগম যেন সুবিচার পান, সে ব্যাপারে তাঁদের নজর থাকবে। আজ সোমবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক যাচ্ছেন গোসিঙ্গা ইউনিয়নের কর্ণপুর গ্রামে।