সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের কার কী পরিমাণ অর্থ আছে সে তথ্য পেতে সুইজারল্যান্ডের রাজস্ব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যবিনিময় (ইওআই) চুক্তি করার প্রক্রিয়া চলছে। সেই সঙ্গে দুই দেশের রাজস্ব কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিদ্যমান দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি (এগ্রিমেন্ট অন ডাবল ট্যাক্সেশন অ্যাভোয়ডেন্স বা ডিটিএ) সংশোধন করা হচ্ছে। তথ্যবিনিময় চুক্তি সই এবং দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি সংশোধন হলে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখা বাংলাদেশি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ও অর্থের পরিমাণ জানতে পারবে সরকার। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এনবিআরের দাবি, এসব চুক্তির ফলে তথ্যবিনিময় ও আর্থিক অপরাধ তদন্তে প্রতিবন্ধকতা দূর হবে উভয় দেশের মধ্যে। তবে এ দুই চুক্তিতে শর্ত থাকছে, গচ্ছিত অর্থ থেকে শুধু রাজস্ব আদায় করা যাবে; অর্থ ফেরত চাওয়া বা অর্থের মালিকদের বিরুদ্ধে আদালতে যেতে পারবে না বাংলাদেশ সরকার। সব দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে চলতি অর্থবছরের মধ্যে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের মালিকদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জানা যাবে। সংশোধিত ডিটিএ চুক্তির আওতায় বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশনে ট্যাক্স সেল খোলা হবে। গচ্ছিত অর্থ ও মালিক সম্পর্কে তথ্য পেতে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের করতে যাওয়া ইওআই চুক্তিতে সময়োপযোগী দু-একটি ধারা যুক্ত করা হবে।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ডিটিএ চুক্তি সংশোধনের লক্ষ্যে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখার (সিআইসি) পাঁচ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সের সদস্যরা গত ১ থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ভারতের কর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সে দেশের ডিটিএ চুক্তি নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেন। অর্থপাচারের বিরুদ্ধে ভারত সরকার কঠোর অবস্থান নিয়ে সাফল্য পাওয়ায় তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।
টাস্কফোর্সের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আশা করি আগামী তিন মাসের মধ্যে এসব কাজ শেষ হবে।’
এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ বিভিন্ন রাজস্ব সংক্রান্ত চুক্তির আওতায় পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করছে। একইভাবে রাজস্ব বোর্ডও চেষ্টা করছে। আমি আশাবাদি রাজস্ব বোর্ডের এ উদ্যোগে সাফল্য পাওয়া যাবে।’
এসব চুক্তি হলে পাচার হওয়া অর্থ থেকে রাজস্ব আদায়ে বিশেষ আইনি ক্ষমতা পাবে এনবিআর। এনবিআরের সাবেক চেয়ারমান আব্দুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থ সম্পর্কে তথ্য জেনে তা থেকে রাজস্ব আদায়ে সক্ষম হলে তা হবে বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য। আবার ভবিষ্যতে অর্থ পাচারেও ভয় পাবে অসাধু ব্যক্তিরা।
গত জুনে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) প্রকাশিত ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৩’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ২০১৩ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের অন্তত ৩৭ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ (প্রায় তিন হাজার ১৬২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা) গচ্ছিত আছে। একই সময়ে ভারতীয়দের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ১৩ হাজার ৬০০ কোটি রুপি। এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ এবং ভারতীয়দের প্রায় ৪৫ শতাংশ। এমন তথ্য পেয়ে নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার। ওই অর্থ ফিরিয়ে আনতে এবং পাচারকারীদের তালিকা পেতে বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর এ বিষয়ে কাজ শুরু করে।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ১৮০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ পাচার হওয়ায় প্রায় ৩৫ কোটি ৯০ লাখ ডলারের বেশি রাজস্ব হারাছে সরকার। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্যের আলোকে এনবিআর জানায়, অর্থপাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এখন চার নম্বরে।
রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে ভারতীয় নাগরিকদের রাখা অর্থের তথ্য পেতে ভারত সরকার ২০০৯ সাল থেকে চেষ্টা করলেও কিছুটা সফলতা এসেছে গত অক্টোবরে। সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্সসহ ১১টি দেশের রাজস্ব বিভাগের সঙ্গে ভারতের রাজস্ব বিভাগের ডিটিএ চুক্তি সংশোধন করে এর আওতায় ওই ১১টি দেশে ইনকাম ট্যাক্স ওভারসিজ ইউনিট (আইটিওইউ) খুলেছে ভারত। এনবিআর সূত্র জানায়, বিদেশে পাচার হওয়া ৫৬৫ কোটি রুপি শনাক্ত করে সম্প্রতি ১৮১ কোটি রুপি দেশে ফিরিয়ে নিতেও সক্ষম হয়েছে ভারত।
গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের কাছে সুইস ব্যাংকগুলোয় গচ্ছিত বাংলাদেশিদের অর্থের তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও বিএফআইইউয়ের উপপ্রধান মাহফুজুর রহমান গত ১২ নভেম্বর কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড কর্তৃপক্ষ চিঠির বিষয়ে কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি।
২০১৩ সালের জুলাই থেকে বাংলাদেশ এগমন্ট গ্রুপের সদস্য। সুইজারল্যান্ডও এ গ্রুপের সদস্য। তথ্য আদান-প্রদান করতে গ্রুপের সদস্য দেশগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করতে হয়। সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে এ ধরনের কোনো এমওইউ হয়নি বাংলাদেশের।
বিভিন্ন দেশের রাজস্ব বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে গত জুলাইয়ে এনবিআরকে নির্দেশ দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বিদ্যমান ডিটিএ চুক্তির আওতায় সুইস ব্যাংকে থাকা অর্থ ফেরত আনার নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুসরণ করতে বলেন তিনি। এ অবস্থায় এনবিআর থেকে অর্থপাচার-সংক্রান্ত একাধিক আইন ও চুক্তি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এতে জানানো হয়, বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা ও পাচারকারী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার বিষয়ে ‘তদন্তকারী সংস্থা’ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ আইনে ‘করসংক্রান্ত অপরাধ’ তদন্তের দায়িত্বও দুদকের। আবার বিদ্যমান ডিটিএ চুক্তি অনুযায়ীও কোনো দেশ পাচারসংক্রান্ত তথ্য দিতে বাধ্য নয়। তাই পাচার করা অর্থসংক্রান্ত তথ্য পেতে এনবিআরের ক্ষমতা সীমিত। এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে ভারতের আদলে বাংলাদেশে বিদ্যমান চুক্তি সংশোধন করার তাগিদ দেয় এনবিআর। এ ছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়, তথ্য পেতে হলে উভয় দেশের মধ্যে ইওআই চুক্তি প্রয়োজন। এরপর সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এনবিআরকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সুইজারল্যান্ড সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুইস ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশিদের অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে বৈঠক করতে সে সময় এনবিআর চেয়ারম্যানসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি সুইজারল্যান্ড সফর করে।
– See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/11/18/152400#sthash.2PuY2eyX.dpuf