প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই তিন অঙ্গের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে এবং একে অন্যের সম্পূরক হিসেবেই কাজ করবে।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ‘একে অপরকে অতিক্রম করবে না বা ক্ষমতার শক্তি দেখাবে না। ক্ষমতা কিন্তু কারও কম নয়। এখন কে কাকে সম্মান করবে এবং কে কাকে করবে না, কে কার সিদ্ধান্ত মানবে আর কারটা নাকচ করবে—এই দ্বন্দ্বে যদি আমরা যাই; তাহলে কিন্তু একটা রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার রাজধানীর কাকরাইলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জন্য নবনির্মিত আবাসিক ভবন উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন। ২০ তলা ভবনটি ১ দশমিক ৫ একর জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ৭৬টি ফ্ল্যাট আছে। প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালের মে মাসে ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ভবনটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭৪ কোটি টাকা।
সংসদে আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটি আইন যখন মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যায়, সেখান থেকে আমরা মন্ত্রিসভায় বসে নীতিগত সিদ্ধান্ত দিই, প্রথম রিডিংটা ওখানে আমরা করি। এরপর এটি চলে যায় আইন বিভাগে ভেটিংয়ের জন্য। সেখান থেকে ভেটিং হয়ে আবার মন্ত্রিসভায় আসার পর সেটাকে আবার আমরা রিডিং দিয়ে অনুমোদন দিই এবং এটা চলে যায় সংসদে।’
প্রধানমন্ত্রী এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, ‘সংসদে বিল যাওয়ার পর সেটার সঙ্গে যদি আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে সেটি অর্থ মন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যায় এবং তিনি সই করে দেন। সেখানে থেকে সংসদে আসার পর বিল আকারে এটি সংসদে উত্থাপন করা হয়, এ সময় বিরোধী পক্ষের কারও যদি বিলটির বিষয়ে কোনো আপত্তি থাকে, ওই সময়ই তাঁরা চাইলে আপত্তি দিতে পারেন। এরপর আপত্তি গ্রহণযোগ্য হলে সেটা গ্রহণ করা হয়, আবার বিলটি ফেরত পাঠানো হয়। আর যদি আপত্তি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে সেটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে চলে যায় এবং ওই কমিটিতে দীর্ঘদিন এটা আলাপ-আলোচনা হয়। এই আলোচনার সময় সংশ্লিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয়ের যদি কোনো প্রতিনিধির প্রয়োজন হয়, তখন তাদের ডেকেও আলোচনা করা হয় এবং সবশেষে ওই কমিটি আবার বিলটি সংসদে উত্থাপন করে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সংসদে উত্থাপনের পর সময় দেওয়া হয়—যদি কেউ এখানে কোনো সংশোধনী দিতে চান দফাওয়ারি সংশোধন ও জনমত যাচাইয়ের জন্য। যাঁরা জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করবেন, তাঁরা সংসদে এর সপক্ষে বক্তব্য দেবেন এবং এর মধ্যে দফাওয়ারি সংশোধনী দিলে সেগুলো গ্রহণ করেই বিলটি পাস করার জন্য এবং বিবেচনার জন্য উত্থাপন করা হয়। তারপর পাস হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা একটা আইন এতগুলো ধাপ পেরিয়ে পাস করি। প্রতিটি আইন যখন পাস করা হয়, তখন বিষয়টি নেওয়াই হয় জনগণের কোনো না কোনো স্বার্থে। আর সেই আইনটি যদি আমরা দেখি দুজন বিচারপতি বসে নাকচ করে দিলেন। আর কিছুই করার থাকল না। তাহলে এত দিন ধরে খাটাখাটুনি, সরকারি কর্মকর্তা থেকে জনপ্রতিনিধি—সবাই মিলে যে খাটাখাটুনি করল, সব কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে বোধ হয় আরও বিবেচনার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।’
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অনুষ্ঠানে কিছু প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি কিছু প্রসঙ্গ তুলেছেন। তাঁকে অনুরোধ করব—রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়া এবং বিচারপতিদের নিয়োগ দেওয়া। এখানে আমার কিন্তু কোনো ক্ষমতা নেই। সংবিধানেই আছে, রাষ্ট্রপতি যখন বিচারপতি নিয়োগ দেন, তখন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করবেন। কাজেই এখানে কোনো রকম কিছু হলে সেটা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করাটাই ভালো। আর এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করণীয় থাকলে নিশ্চয়ই আমরা সেটা দেখব। আমি চাই না এ রকম কোনো কথা উঠুক যে আমাদের দ্বন্দ্ব বা কোনো কিছু আছে। এ ধরনের কথা উঠলে এটি সমগ্র জাতি বা জনগণের জন্য ভালো হবে না। বিচার বিভাগের ইমেজ যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হবে, তেমনি আইন ও নির্বাহী বিভাগ সমন্ধেও জনগণ একটা ভুল ধারণা নিয়ে যাবে। যেকোনো বিষয় আমি মনে করি, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা উচিত এবং সেগুলো বিবেচনা করে দেখা উচিত বলে আমি মনে করি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিচারকদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিতে হয়। বিএনপি দু–দুজন বিচারককে বোমা মেরে হত্যা করেছে, গাজীপুর ও ঝালকাঠিতে। এ রকম ঘটনাও ঘটে গেছে বাংলাদেশে এবং তারপর থেকে আমরা শঙ্কিত হই। কাজেই বিচারপতিদের নিরাপত্তার বিষয়টাও আমরা চিন্তা করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিচার বিভাগকে আমরা আধুনিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি, আদালতে বসেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যেন বিচারকার্য করা যায়। যারা দুর্ধর্ষ আসামি, তাদের আদালতে আনা একটি কঠিন কাজ। ইতিমধ্যেই আসামি ছিনতাইয়ের চেষ্টাও হয়েছে আমরা দেখেছি।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘কেরানীগঞ্জের যে জেলখানা করা হয়েছে, সেখানে আমি নির্দেশ দিয়েছি বিশেষ কক্ষ করে দেওয়ার, যেন ঢাকা থেকে বসেও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ওখানে বিচারকার্য পরিচালনা করা যেতে পারে। আসামি নিয়ে যেন টানাটানি করতে না হয়। সেখানে আইনজীবীরাও থাকবেন, সে রকম ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। আর এ ধরনের আধুনিক বিচারব্যবস্থা বিশ্বে চালু আছে আর আমরা সেটাই অনুসরণ করতে চাই।’
জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার অঙ্গীকার করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আমি ধন্যবাদ জানাই। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে নানা ধরনের হুমকি আমরা পেয়েছিলাম। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সক্রিয় থাকায় সমগ্র বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে নববর্ষ উদ্যাপিত হয়েছে। নববর্ষের সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। এর সঙ্গে অর্থনীতির একটা সম্পর্ক আছে। পুরোনো হিসাব মিলিয়ে হালখাতা করে আবার নতুন করে হিসাব শুরু হয়। দেশে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষই নববর্ষ পালন করে।’