সকাল বেলায় সজিব বলছিলো তাদের হাওর এলাকার কৃষক স্বর্বশান্ত হয়ে গেছে বৃষ্টির পানিতে বাঁধ ভেংগে । চোখের সামনে একে একে তলিয়ে যাচ্ছে হাওর। সবুজ অবারিত ফসলি মাঠ কোন এক অশুভ শক্তিবলে রাতারাতি সাদা হয়ে যাচ্ছে! যেদিকে চোখ যায় শুধু সাদা জলরাশি! হাওড়ের মানুষগুলোর কথা একবার ভাবতে পারছেন কি!! বৈশাখ আসেনি এখনো। চৈত্র মাস শেষ হতে আরো পাঁচদিন! ধান কাঁচা, সবুজ। এখনি সোনালি রং হবার কথাও না। অথচ সর্বনাশা বান সব তলিয়ে দিলো! কৃষকের সারা বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম জলের বানে ভেসে যাচ্ছে। কারো কিচ্ছু করার নাই। ধান সামান্য পাকলেও নাহয় কেটে নেয়া যেতো! সবুজ, ধানের ভিতরে দুধ চাল, এ কেটেও লাভ নেই। বর্ষার পানি নামতে নামতে কার্তিক মাস শেষ হয়ে যায়। তারপর ৬ মাস পানির নিচে থাকা ফসলি জমিগুলো চাষযোগ্য করতে কৃষক ঝাপিয়ে পড়ে। দেশের অন্যান্য এলাকার কৃষকরাও ঝাপান। তবে হাওয়ের কৃষকদের ঝাপিয়ে পড়া ভিন্ন। এদের নাওয়া খাওয়া ভুলতে হয়। দিন আর রাতের পার্থক্য ভুলতে হয়। এদের পরিশ্রমের সাথে “অমানুষিক” শব্দটা আপনি সহজেই যুক্ত করতে পারেন। কারন এরা জানে, যত দ্রুত সম্ভব চাষ শুরু করতে হবে। ধানকে তো পাকার সময়টা দিতে হবে! বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্তই তাদের হাতে সময়। অগ্রহায়ন থেকে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ, এই ৫ মাসেই যাবতিয় কাজ শেষ করে ধান পাকাতে হবে! জোর করে অল্পসময়ে ধান তো পাকানো যাবেনা! তাই প্রতিমুহুর্তেই তাদের পরিশ্রম কয়েকগুন করে বেশি করতে হয়! হাওরের মাটি! পলির আবরনে গড়ে ওঠা মাটি! ফসল হয় বাম্পার! চোখ জুড়ানো ফসল! চারদিকে সবুজ আর সবুজ! কৃষক ফলন দেখে সব কষ্ট ভুলে, আরো কষ্টের জন্য তৈরি করে নিজেরে! ধান পাকলেই কাটতে হবে! দেরি করা যাবে না। শিলাবৃষ্টির ভয় আছে, আউলা বাউলা বাতাসের ভয় আছে। আর জলের ভয়তো আছেই! একফসলি এসব জমি। ধানেই স্বপ্ন, ধানেই জীবন, রুটি, রুজি! এ ফসলই সারা বছরের একমাত্র সম্পদ। এই দিয়েই যাবতিয় চাহিদা মিটে যায়, মিটাতে হয়। তাই এই সময়টা কৃষকের অদ্ভুত অনুভুতির মাঝ দিয়েই কাটাতে হয়! হাওরে পানি ডুকছে। ফসলি জমি চোখের সামনে একে একে তলিয়ে যাচ্ছে। কৃষকেরা পাগলের মতো বাঁধে মাটি দিচ্ছে। যার যা জোর আছে, পারলে নিজের শরিরটা বিছায়ে দেয় বাঁধের মাঝে। তবু পানি থামাও। পানি আটকে রাখো! এ পানি ডুকতে দেয়া যাবেনা। পানি ডুকা মানে সকলের রুজি শেষ। স্বপ্নগুলো শেষ। আরো একটা বছর কী খাবে, কী করবে- এমন অনির্দিষ্ট দোলাচালে ভোগা। তাই পানি থামাতে বাঁধ আঁকড়ে থাকে সকলে! নড়ে না কেউ, চেষ্টাও থামায় না কেউ, যতক্ষন না পানি তাদের হাঁটু ছাড়িয়ে কোমর পর্যন্ত উঠে! তারপর একসময় থামে সবাই। সেখানেই কেউ রয়ে যায়। কেউ নিজের জমির সামনে দাড়িয়ে ফসলের সাথে সাথে ডুবতে দেখে একটা বছরের রুটি- রুজি! একটা বছর ধরে দেখতে থাকা স্বপ্ন!! তিলে তিলে, রক্ত পানি করা পরিশ্রমে ফলানো ফসল যখন আর ১০-১৫ দিন সময়টুকু না দিয়ে জলের বানে তলিয়ে যায়, তখন কৃষকের কী করার থাকে! অসহায় মানুষগুলোর তখন কান্না ছাড়া আর কিছু করার নাই! তাই তারা কান্না করে! তাদের বুকফাটা কষ্টরা কান্নার সাথে আর্তনাদ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে হাওরের কোনায় কোনায়! এ এক অসম্ভব দৃশ্য। অসহনীয় অবস্থা!! এ অবস্থা দেখতে নেই! এ অবস্থা দেখতে নেই। চোখ কান বন্ধ করে রাখুন। টিভি, পত্রিকায় অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হোন! নাহয় আবার ভারত থেকে জলের বানেই ভেসে আসা মহান হাতি “বঙ বাহাদুর”- সাহেবের আগমনের ভিডিওগুলোর পুনঃপ্রচার দেখুন!!