আজ শুক্রবার ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুতে শেখ হাসিনা তাঁর লেখা এক নিবন্ধে এ কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্ব বহতা নদীর মতো এবং তা ঔদার্যে পূর্ণ। দুই প্রতিবেশী দেশের জনগণের এটাই মূল চেতনা। প্রতিশ্রুতি সৎ হলে দুই দেশের জনগণের কল্যাণে অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব।
শেখ হাসিনা বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ‘বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর, যখন আমার দল ক্ষমতা গ্রহণ করে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহুমুখী সহযোগিতা আরও শক্তিশালী হয়। রেল, সড়ক ও জলপথে কানেকটিভিটির ব্যাপক উন্নয়ন হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সর্বোচ্চ বাড়ে। দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্কও গতিশীল হয়। এ ধরনের পারস্পরিক সহযোগিতা নিশ্চিতভাবে মানুষের উপকারে আসছে। সম্পর্ক, ব্যক্তিগত বা জাতীয় পর্যায়ে হোক, তা লেনদেনের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। মেক্সিকোর নোবেলজয়ী অক্টাভিও পাস বলেছেন, “বন্ধুত্ব হলো নদীর মতো।” আমি মনে করি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্ব বহতা নদীর মতো এবং তা ঔদার্যে পূর্ণ। দুই প্রতিবেশী দেশের জনগণের এটাই মূল চেতনা। আমি মনে করি, প্রতিশ্রুতি যদি সৎ হয়, আমরা অনেক কিছু অর্জন করতে সক্ষম হব, যাতে দুই দেশের জনগণ উপকৃত হবে। ভারতে চার দিনের সফরে আমি নিজে এবং আমার দেশের মানুষের পক্ষ থেকে, ভারতের জনগণের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাতে চাই। আমি আশা করি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এই সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক আমার সফরের মধ্য দিয়ে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।’
আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয় তুলে ধরে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আমি সব সময় দারিদ্র্যকে এ অঞ্চলের প্রধান শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশ ও ভারতের বিপুলসংখ্যক মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। তারা মৌলিক চাহিদা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। পুষ্টির অভাবে বিপুলসংখ্যক শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের এ পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের সক্ষমতা আছে। আমাদের যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে মানসিকতার পরিবর্তন। আমি মনে করি, আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দারিদ্র্য নিরসন প্রথম এবং সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। আজ বিশ্বায়নের যুগে এককভাবে কোনো কিছু করা কষ্টকর। এর চেয়ে সহযোগিতা ও সহায়তা অনেক কিছুকে সহজ করে তুলতে পারে। এ কারণে আমি সব সময় আঞ্চলিক সহায়তা ও কানেকটিভিটির উন্নয়নের ওপর জোর দিই।’
নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বিদ্বেষ নয়—আমার সারা জীবনের লক্ষ্য এটা। আমার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় একমাত্র আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে কেউ দারিদ্র্যের অভিশাপে দুর্ভোগ পোহাবে না, সেখানে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে। অন্য কথায়, তারা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, উন্নত ও মানসম্মত জীবন পাওয়ার সুযোগ পাবে।’
শেখ হাসিনা নিবন্ধে বলেন, ‘আমার বাবার কাছ থেকে আমি এই শিক্ষাই পেয়েছি। আমার বাবা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। যেখানে অন্যায় হয়েছে, সেখানে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর নীতি এবং তিনি সব সময় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ছিলেন এবং এ কারণে তাঁকে কারাবন্দী হতে হয়েছে বারবার এবং দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি নীতির প্রশ্নে অটল ছিলেন। বাংলাদেশ তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।’
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অবদান উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওই সময় ভারতের জনগণ ও সরকার নিপীড়নের শিকার বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েছিল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা সবদিক দিয়ে সহায়তা করেছিল এবং বাংলাদেশর পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এটা আমাদের বিজয় অর্জনে এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সহায়তা করেছিল। ভারতের বন্ধুসুলভ জনগণের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ছয় বছর দেশে ফিরতে না পারা, ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং ২০০১ সালে নির্বাচনে হার এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শাসনামলে জঙ্গিবাদের উত্থান ও জনগণের দুর্ভোগের অভিযোগ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘২০০১ সালের নির্বাচনে আমরা জয়ী হতে পারিনি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নেয় এবং আমাদের সব অর্জনকে ধ্বংস করে দেয়। আবারও দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, দুর্নীতি ও অপশাসন জনসাধারণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। দেশ পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতনের শিকার হয়। আর্থসামাজিক উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা উৎপীড়নের লক্ষ্যে পরিণত হয়। বাংলাদেশ আবারও জরুরি শাসনের মধ্যে পড়ে। আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবি জানাই। আমরা কারাবন্দী হয়েছি, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণ জয়ী হয়েছে।’