সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি ‘মাতারবাড়ী-মদনাঘাট-মেঘনাঘাট ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন’ নামের এই প্রকল্পের আওতায় ওই লাইন নির্মিত হতে যাচ্ছে। বন বিভাগ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা সংরক্ষিত বনের মধ্যে এই বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছেন। তাঁরা বনের বাইরে দিয়ে এই লাইন নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ওই সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কারণে যে পরিমাণ গাছ কাটা পড়বে, তার চেয়ে বেশি গাছ তারা অন্যত্র রোপণ করবে।
এই পরিস্থিতিতে আজ ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বন দিবস পালিত হচ্ছে।
এই সংরক্ষিত বনের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এলাকা বাড়ৈয়ারঢালা জাতীয় উদ্যান ও হাজারিখিলে বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য অবস্থিত। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই বনভূমির মধ্যে দেশের দীর্ঘতম বৃক্ষ ‘বইলাম’ রয়েছে। এক-দেড় শ ফুট উচ্চতার এই বৃক্ষটি দেশের বেশির ভাগ এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে এখন শুধু চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বনভূমিতে রয়েছে। একইভাবে সবচেয়ে বড় আকৃতির বুনো ছাগল (প্রায় ৩০ কেজি), বনমোরগ ও বনবিড়ালের বসতি রয়েছে। আরও রয়েছে লতাগুল্ম ও হরেক রকমের কীটপতঙ্গের বসতি। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব ছাড়াও এসব প্রাণী ও বৃক্ষকে জিনগত সম্পদ (জেনেটিক রিসোর্সেস) হিসেবে সংরক্ষণ করা জরুরি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে বন দখল করে নিজেদের কাজে ব্যবহার করত। এখন আর তা পারে না। তবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কোনো সরকারি সংস্থা উন্নয়নকাজের জন্য বনের জমি চাইলে আমরা প্রচলিত নিয়ম মেনে সহযোগিতা করে থাকি।’
এই সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নিলে কী ক্ষতি হবে, তার হিসাব করার জন্য বিদ্যুৎ, খনিজ সম্পদ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের পাঁচজন সদস্য নিয়ে একটি কমিটি করা হয়।
গত নভেম্বরে সরকারকে দেওয়া ওই কমিটির সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ফলে ৭৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকার বৃক্ষসম্পদের ক্ষতি হবে। তবে এ ধরনের বনের ক্ষতির যথার্থ হিসাব করার মতো কোনো পদ্ধতি এখনো দেশে নেই বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আরও বলা হয়, ১৩ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই সঞ্চালন লাইন নির্মিত হলে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের ৪১ দশমিক ৪ হেক্টর বন ও বনশিল্প করপোরেশনের আওতাধীন ২১ দশমিক ৬ হেক্টর রাবার বন কাটা পড়বে।
কমিটির হিসাব অনুযায়ী ওই ৬৩ হেক্টর বনভূমিতে প্রায় ২ হাজার চারা গাছ, ১২১টি বাঁশঝাড়, প্রায় দেড় হাজার বল্লী এবং ২২৭টি বিপন্নপ্রায় বন্য প্রাণী রয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, বন আইন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এ ধরনের বন্য প্রাণী ও বৃক্ষ আছে এমন এলাকা সংরক্ষণ করতে হবে। আর সংরক্ষিত বনে কোনো স্থাপনা নির্মাণ তো দূরে থাক, কোনো বৃক্ষ কাটা হলেও প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির দরকার হয়।
এ ব্যাপারে ওই কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জগলুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেশের প্রচলিত বন ও পরিবেশ আইন অনুযায়ী ওই বনভূমি সংরক্ষণ করার গুরুত্ব উল্লেখ করে সরকারকে জানিয়েছি। এখন বাকি সিদ্ধান্ত কী হবে, সে ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারব না।’
জানতে চাইলে এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আহমেদ কায়কোয়াস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে পরিমাণ গাছ কাটব, তার চেয়ে বেশি গাছ অন্য জায়গায় রোপণ করে দেব। প্রয়োজনে বন বিভাগকে ক্ষতিপূরণ দেব।’
অবশ্য এমন সংরক্ষিত বনের সম্পদকে আর্থিক মূল্যে নিরূপণ করার সুযোগ নেই বলে মনে করেন প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশ কার্যালয়ের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এসব বনের এমন অনেক সম্পদ আছে, যা এখনো দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা জানতেই পারেননি। ফলে যেকোনো বনভূমিকে অন্য কাজে ব্যবহারের আগে এর জীববৈচিত্র্য ও অন্যান্য সম্পদের একটি সঠিক সমীক্ষা করা দরকার। কিসের বিনিময়ে আমরা কী পাচ্ছি, তা হিসাব করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’