স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
গ্রাম বাংলা নিউজ২৪.কম
গাজীপুর অফিস : ঘুষ না দিলে পাসপোর্ট আসে না। ঢাকার আগারগাঁও থেকে আসতে সময় অনেক সময় লেগে যায়। আর দ্বিগুন টাকা দিলে সময়মতই পাওয়া যায়। কথাগুলো বলেছে গাজীপুর পাসপোর্ট অফিসে দালালদের ব্রকার দশম শ্রেনীর ছাত্র এক ছাত্র ও এক দালাল।
বৃহসপতিবার বিকালে গাজীপুর আদালত ভবন সংলগ্ন ট্যাংকির পাড়া এলাকায় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায় ওই দৃশ্য। মেশিন রিডবল পাসপোর্ট জনগন হাতের কাছে সহজলভ্য ভাবে পাওয়ার জন্য সম্প্রতি উদ্বোধন হয় সম্প্রতি উদ্বোধন হয় গাজীপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। হয়রানীর হাত থেকে বাঁচার জন্য সরকারের এই ব্যবস্থার প্রতিফলন হয়েছে ঠিক উল্টো।
সরেজমিন দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসে কর্তব্যরত কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল গেটের ভেতরে রয়েছেন। তাদের সামনেই হচ্ছে অবৈধ লেনদেন। পাসপোর্ট অফিসে লাইন ধরে দাঁড়ানো লোকগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দালালরা। নারী পুরুষ দালালদের পাশাপাশি দালালদের ব্রকার হিসেবে কাজ করছে অল্প বয়সী কয়েকজন ছেলে। ৫/৭জন ওই বয়সী ছেলেকে দালালদের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে ব্যস্ত দেখা যায়। ফরম পূরণ থেকে জমা দেয়া ও পাসপোর্ট উঠানো তাদের কাজ।
লাইনে দাঁড়ানো জনৈক ব্যাক্তি পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়ার সময় জনৈক তুহিনের হাতে প্রকাশ্যেই দিয়ে গেলেন কয়েকটি বিশ টাকা নোট। এই দৃশ্য দেখে তুহিনের কাছে গিয়ে এই প্রতিবেদক একটি পাসপোর্ট করার কথা বলেন। অতঃপর তুহিন অকপটে বলে ফেলে একটি পাসপোর্ট জরুরীভাবে তিন দিনের মধ্যে করতে হলে ৯হাজার টাকা লাগবে। পুলিশ সহ সব মিলিয়ে ১২ হাজার টাকার মত খরচ হবে। অথচ এই পাসপোর্ট ৬হাজার টাকায় পাওয়ার কথা রয়েছে।
তুহিনের সঙ্গে মিশে কথা বলার পর সে জানায়, পাসপোর্ট অফিসের সঙ্গেই তাদের বাসা। গাজীপুরের হাড়িনাল উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেনীর ছাত্র সে। পাসপোর্ট অফিসের দালাল জনৈক আসাদ মিয়ার অধীন তুহিন কাজ করে। পার্টি ধরিয়ে দিলে সে কমিশন পায়। আসাদ মিয়ার মোবাইল নাম্বার চাইলে তুহিন জানান, উনার নাম্বার আমার কাছে নাই। অর্থাৎ পার্টি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে তুহিন তার দালালের নাম প্রকাশ বা মোবাইল নাম্বার দিতে চায় নি। তবে পাসপোর্ট অফিসে প্রতি পাসপোর্টের জন্য কাকে ঘুষ দিতে হয় তা জানলেও এড়িয়ে যায় তুহিন।
গোপন অনুসন্ধানে জানা গেলো, পাসপোর্ট অফিসের নীচ তলায় ১০২ নম্বর রুমে ছবি তোলার কাজ করেন পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম। তাকেই দিতে হয় পাসপোর্ট প্রতি এক হাজার টাকা ঘুষ। মাজহারুল ইসলামের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, কোন টাকার লেনদেন নেই। জানা গেলো, দালালদের হাত থেকে তিনি টাকা নেন। ধরা পড়ার ভয়ে কোন মক্কেলের হাত থেকে নেন না। তবে কয়েকজন দালাল তাকে টাকা দিয়েছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
পাসপোর্ট অফিসের একটু সামনে রাস্তার পাশে দেখা গেলো একটি চটপটির দোকান। চা, সিগারেট ও পান পাওয়া যায় ওই খানে। ৩/৪টি করে চেয়ার দিয়ে সাজানো এক একটি প্লাস্টিকের ছাতার নীচে বসে শুধু পাসপোর্টের দালালীর কাজ হয়। ছাতা গুলোর পাশে আর একটি ছাতার নীচে বসে আছেন মামুন মিয়া ডাক নাম হাজারি মামুন। জানা গেলো, মামুন মিয়া পাসপোর্ট অফিসের সকল দালালদের নেতৃত্বে রয়েছেন। মামুন মিয়ার পাশে বসে চা সিগারেট ফুকছেন বিদ্যুত নামে এক ভদ্রলোক। স্থানীয় নীলের পাড়া গ্রামে বাড়ি দাবি করে বিদ্যুত জানালেন, ঘুষ না দিলে পাসপোর্ট পাওয়া যায় না। আগে চালান জমা দেন। তার পর সিস্টেম করে পাসপোর্ট বের করে দেই।
অন্ত:রঙ্গভাবে কথা বলার সময় বিদ্যুত জানালেন, একটি জরুরী পাসপোর্ট ৬হাজার ১’শ টাকা চালান ব্যাংকে জমা দিতে হয়। এরপর পাসপোর্ট অফিসে নির্ধারিত চ্যানেলে ১ হাজার টাকা দেয়া লাগে। ওই টাকা না দিলে ঠিকানা ভূল লিখে ফরম ফেলে দেয়া হয়। অফিস খরচ ছাড়া পুলিশ ভ্যারিফিকেশন করতে নির্ধারিত ৮’শ টাকা লাগে। ওই টাকা দিলে পুলিশ আর তদন্তের জন্য বাড়ি যাবে না। বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় বাড়ি হউক না কেন পুলিশকে ৮’শ টাকা দিলেই চলবে। ঠিকানা তখন মূখ্য বিষয় হবে না। পাসপোর্ট পাওয়া যাবে।
বিদ্যুত মিয়া প্রকাশ্যেই বললেন, এগুলো ছাড়া পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত অন্যান্য কর্মকর্তা, কর্মচারী, পুলিশ, স্থানীয় মাস্তান, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সাংবাদিকদেরও ম্যানেজ করা লাগে। তার কথা থেকে বুঝা গেলো, সব মিলিয়ে একটি পাসপোর্টের বিপরীতে চালানের দ্বিগুন খরচ পড়ে যায়। অর্থাৎ ৬হাজার টাকার পাসপোর্ট ১২ হাজার আর ৩হাজার টাকার পাসপোর্ট ৬হাজার টাকা খরচ হয়।
চটপটির দোকানের সামনে গিয়ে দেখা গেল, ছোট ছোট চায়ের দোকানে পাসপোর্টের ফরম পূরনের কাজ চলছে। তুহিনের বয়সী কয়েকজন ছেলে ফরম পূরন করে মূল দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছেন সরকারী চালানের অতিরিক্ত টাকা।
একটি বন্ধ দোকানের সামনে পড়ে থাকা বেঞ্চে পাসপোর্ট হাতে বসে ছিলেন আশিষ নামে ২০/২২ বছর বয়সী একজন ছেলে ও তার এক নিকটাত্মীয়। পাসপোর্ট করতে কত খরচ হয়েছে প্রশ্নের জবাবেব আশিষ প্রথমেই বলে ফেলেছেন, ৩ হাজার টাকা সরকারী চালান হলেও সাড়ে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কার মাধ্যমে তিনি পাসপোর্ট পেয়েছেন জিজ্ঞাসা করলেও তিনি উত্তর এড়িয়ে যান।
পাসপোর্ট অফিসের কয়েকগজ সামনে রাস্তার পাশের জনৈক চায়ের দোকানী জানালেন, পাসপোর্ট অফিসে কম করে হলেও ১৫/২০জন দালাল রয়েছেন। দালালদের সহযোগী হিসেবে স্কুল ছাত্র রয়েছে ২০/৩০ জন। পুরুষ দালালদের পাশাপাশি মেয়ে দালালের সন্ধানও পাওয়া গেলে। তবে মেয়ে দালালদের প্রধান হিসেবে জনৈকা বিনা রানী নামে এক নারীর নাম জানা গেলো। বাকী নারী দালালদের নাম জানা যায় নি। বিনাকে দেখে মনে হলো তার বয়স অনুর্ধ ৩৫ হবে। তার সঙ্গে রয়েছেন আরো কয়েকজন মেয়ে দালাল।
এ সকল বিষয়ে গাজীপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের অভিযুক্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি নীরবে অন্য রুমে চলে যান। এর কিছুক্ষন পর জনৈক দালাল এই প্রতিবেদককে বলেন, ভাই ঝামেলা করে লাভ কি? সবাই তো পাচ্ছেন। আপনিও কন্ট্রাকে আসেন।
পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের দায়িত্ব প্রাপ্ত গাজীপুর জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মোঃ মোমিন মিয়া জানান, ৮’শ টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের সংবাদ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ঠিকানা যাচাই বাছাই ছাড়া কোন পাসপোর্ট দেয়া হয় না। ঘুষ নেয়ার প্রশ্নই আসে না।
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা(এনএসআই) গাজীপুর অফিসের ফিল্ড অফিসার মোঃ শহীদুল্লাহ জানান, ঘুষ নেয়ার প্রশ্নই আসে না। গোয়েন্দা সংস্থা কোন সময় ঘুষ খায় না। অভিযোগ থাকলে তা অবশ্যই ভিত্তিহীন।
এ প্রসঙ্গে গাজীপুর প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি মীর মোঃ ফারুক বলেন, সাংবাকিদের নামে কোন চাঁদা নেয়ার প্রশ্নই আসে না। যদি কেউ নিয়ে থাকেন তবে তাকে আটক করে ফোন করার জন্য তিনি অনুরোধ করেন্