নূরে আলম সিদ্দিকী; সাংবাদিকতা আজকে প্রান্তিক জনতার কথা অকুতোভয়ে, অসংকোচে তুলে ধরতে পারছে না। রাজনৈতিক অঙ্গনের মতো
বিভাজনের কালো মেঘ তাদের দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের প্রদীপ্ত সূর্যটিকে রাহুর মতো গ্রাস করেছে। তাদের প্রায় সকলেই আজ দু’টি রাজনৈতিক জোটের স্রোতধারায় এমনভাবে গা ভাসিয়েছেন যে, মনে হয় যেন তারা রাজনৈতিক জোট দু’টির খেলার পুতুল। ফলে বিভাজন ও বিভক্তি তাদের নিরপেক্ষ অস্তিত্বকে বিপন্ন করে ফেলেছে। যে নির্ভীক সাংবাদিকতা তাদের প্রজ্জ্বলিত আলোকরশ্মিতে মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যরশ্মির মতো বিকীর্ণ অগ্নিকণায় দেশের প্রথিতযশা রাজনীতিকদেরও পথ দেখাতো, আজকে সেই সাংবাদিকতাই বিভাজনের ভ্রান্তিবিলাসের নির্মম শিকার। প্রসঙ্গক্রমে আমি সাংবাদিকতার অতীত ঐতিহ্যের গৌরবোজ্জ্বল কিছু চিত্র তুলে ধরতে চাই।
বিভাজনের কালো মেঘ তাদের দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের প্রদীপ্ত সূর্যটিকে রাহুর মতো গ্রাস করেছে। তাদের প্রায় সকলেই আজ দু’টি রাজনৈতিক জোটের স্রোতধারায় এমনভাবে গা ভাসিয়েছেন যে, মনে হয় যেন তারা রাজনৈতিক জোট দু’টির খেলার পুতুল। ফলে বিভাজন ও বিভক্তি তাদের নিরপেক্ষ অস্তিত্বকে বিপন্ন করে ফেলেছে। যে নির্ভীক সাংবাদিকতা তাদের প্রজ্জ্বলিত আলোকরশ্মিতে মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যরশ্মির মতো বিকীর্ণ অগ্নিকণায় দেশের প্রথিতযশা রাজনীতিকদেরও পথ দেখাতো, আজকে সেই সাংবাদিকতাই বিভাজনের ভ্রান্তিবিলাসের নির্মম শিকার। প্রসঙ্গক্রমে আমি সাংবাদিকতার অতীত ঐতিহ্যের গৌরবোজ্জ্বল কিছু চিত্র তুলে ধরতে চাই।
এদেশের সাংবাদিকতা জগতের দিকপাল, সাংবাদিকদের মুকুটহীন সম্রাট তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আওয়ামী লীগের দু’আনার সদস্যও ছিলেন না। অথচ তাঁর কলাম ‘মুসাফির’ আওয়ামী লীগের দিকদর্শন ছিল। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৬ দফা মানিক ভাইয়ের সমর্থন লাভের আগে জনপ্রিয়তার হিমাচলে প্রতিস্থাপিত হতে পারেনি। মানিক ভাই রাজনীতির জন্য সাংবাদিকতা করতেন। তাই ডন-এর সম্পাদক সুলেরীকে লক্ষ্য করে লিখেছিলেন- ‘সুলেরী সাহেব, আমি রাজনীতির জন্য সাংবাদিকতা করি; আর আপনি সাংবাদিকতার জন্য রাজনীতি করেন।’ ডন-এর সম্পাদকের পদটি আঁকড়ে রাখার জন্য সুলেরী সাহেবকে ক্ষমতাসীন দলের কৃপাভিক্ষা করতে হতো। আর মানিক মিয়া এদেশের ম্লান মূক মুখে ভাষা তুলে দেওয়ার জন্য কলম ধরতেন। সাংবাদিকতার জগতে আরেক দিকপাল সাংবাদিক গড়ার কারিগর সিরাজুদ্দীন হোসেন সম্পর্কে দু’-একটি কথা অবশ্যই বলতে হয়। কী দুর্দমনীয় সাহস ছিল সিরাজুদ্দীন হোসেনের সাংবাদিকতায়! কোন প্রলোভন, প্রাপ্তি, প্রত্যাশা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের চেতনার আবর্তকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। পাকিস্তান আমলে দৈনিক পাকিস্তান প্রকাশনার প্রাক্কালে আইয়ুব খান তখনকার রাষ্ট্রপতি ভবনে ডেকে দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়ার জন্য তাঁকে ইত্তেফাকের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেতন-ভাতা, দু’টো গাড়ি ও ধানমন্ডিতে বাড়ির প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাব কী অবলীলাক্রমে তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিলেন! সিরাজ ভাইকে উস্কানি দেয়ার জন্য আমরা- তাঁর কাছের লোকজন যেমন- রেজা ভাই, মাহমুদ উল্লাহ ভাই, শহীদ তালেব ভাইসহ সকলে বললাম, প্রস্তাবটি লোভনীয়। গ্রহণ করলে আমরাও কিছু বিলাসী জীবনের আস্বাদ পেতাম। ছাত্রদের মধ্যে আমি সিরাজ ভাই’র স্নেহাসিক্ত ও কোলনেওটা ছিলাম। আমিও সিরাজ ভাইকে বলেছিলাম প্রস্তাবটি লুফে নিতে। তখন আমার অন্তর্নিহিত বাসনা ছিল, সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো নির্ভীক ব্যক্তিত্ব দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদক হলে শুধু অর্থবিলাসই নয়, সংবাদপত্রটিও একটু ভিন্ন মাত্রা পেতে পারতো। কিন্তু কোনোকিছুই তাঁর চেতনাকে প্রভাবিত করতে পারে নাই। তাঁর একই কথা; আমি একটি আদর্শকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাংবাদিকতা করি প্রান্তিক জনতার চেতনাকে সামনে রেখে। বিত্ত-বৈভব, বিলাস এখানে অবান্তর। তাঁর অতি সম্মানের অগ্রজপ্রতিম মানিক ভাইকেও তিনি কখনো এতটুকু ছাড় দেন নাই। ৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে তিনি কাঠের হেডলাইনে শিরোনাম দিয়েছিলেন- ‘পূর্ব-বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’। মানিক ভাই সিরাজ ভাইকে তাঁর নিজ কক্ষে ডেকে সস্নেহে বলেছিলেন- সিরাজ সাহেব, পূর্ব-বাংলার জায়গায় পূর্ব-পাকিস্তান বসিয়ে শিরোনামটা একটু বদলে দেয়া যায় না? সিরাজ ভাই’র বিনম্র ও সাহসী উক্তি ছিল- এডিটর সাহেব, আমি ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক। শিরোনাম ঠিক করার একক অধিকার আমার। সম্পাদক হিসেবে আপনি এই শিরোনামটি বদলানোর ক্ষমতা রাখেন। তবে সেক্ষেত্রে আমি আর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যাব না। সোজা চামেলীবাগের বাসায় চলে যাব। অতি দিলখোলা মানুষ ছিলেন মানিক ভাই। তিনি স্মিত হেসে বললেন, চামেলীবাগ যেতে হবে না। আপনার শিরোনামটি বসিয়েই ডামি ছেড়ে দেন। আমি তখন মানিক ভাই’র কক্ষে অবস্থান করছিলাম। পরের দিনের ইত্তেফাকে ওই শিরোনামই প্রকাশিত হয়েছিল। একেই বলে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, এটাই হলো অকুতোভয় হৃদয়। সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বের ব্যাপ্তিময় বিকাশ। রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না থেকেও রাজনীতির পথ-প্রদর্শকের গৌরবময় ভূমিকা তাঁরা পালন করতে পেরেছেন। ঘুটোকুড়োনি বালিকা, ছেলেধরার দৌরাত্ম্য’র মতো অনেক খুঁটিনাটি ছোট ছোট সংবাদ তখনকার সাংবাদিকতায় গুরুত্ব পেত শুধু নির্ভীক পেশাদারিত্বের শক্তিতে।
আজকে সাংবাদিকতার চিত্রটা খোলনলচেসহ বদলে গেছে। গাড়িচাপা দিয়ে মানুষ মারলে আদালতের দেয়া শাস্তির বিরুদ্ধে আচমকা গাড়ির মালিক ও চালক সমিতি ধর্মঘট ডেকে মানুষের চরম ভোগান্তি ও জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করলে সংবাদপত্রের যে বস্তুনিষ্ঠ ও কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করা পেশাদারিত্বের খাতিরে উচিত ছিল, সেটা সুনির্দিষ্ট কারণে তারা নিতে পারেননি। পূর্বের মতো একযোগে পত্রিকাগুলো থেকে একই ভাষায় কোনো প্রতিবাদ আসেনি। আগে এমন পরিস্থিতিতে মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, সালাম খান- এ ধরনের জনদুর্ভোগে একযোগে একই ভাষায় একসাথে যার যার পত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশ করে জানান দিতেন দুষ্কর্মটির বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান শুধু প্রতিবাদমুখরই নয়, একাট্টা।
বর্তমানে একমাত্র প্রেস ক্লাব ছাড়া সাংবাদিকদের সকল সংগঠনই দু’টি ধারায় বিভক্ত। এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য আজকে প্রচণ্ড অন্তরায়। এদেশের মানুষ হতদরিদ্র হৃদয়ে বেদনাবিধুর চিত্তে সবই উপলদ্ধি করেন। তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণও হয়। যে জাগ্রত জনতা এই মার্চ মাসে উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালায় পাকিস্তানের সবকিছুকে ভাসিয়ে দিয়েছিল, তারাই আজ নীরব, নিথর, নিষ্প্রভ। তাদের ম্লান মূক মুখে ভাষা দেওয়ারও কেউ নাই। তাদের ভগ্নহৃদয়ে আশার বাণী ধ্বনিত করারও কেউ নাই। সাংবাদিক সমাজের এই বিভাজনের, আত্মকেন্দ্রিকতার ও আখের গোছানোর অকল্যাণকর মুহূর্তে দৈনিক মানবজমিন-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাদের শুভকামনা জানিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুলনায় হৃদয়টি চরম বিষাদে ভরে ওঠে।
সমাজের সর্বস্তরে, বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুধুই প্রাপ্তি-প্রত্যাশার হিসাব কষা, তাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দুর্দশা, অন্যদিকে সাংবাদিকদের নির্ভীক সত্য প্রকাশের অক্ষমতা অবলোকন করে আমার সমস্ত হৃদয়জুড়ে একটা কথাই মাথা কুটে মরে- এর জন্য তো স্বাধীনতা আনি নি! অযুত-নিযুত মানুষের বুকনিঃসৃত রক্তে আলিঙ্গন করা স্বাধীনতার সূর্য তার বিকীর্ণ অগ্নিকণায় সমস্ত হীনমন্যতার অন্ধকারকে দূর করে দিবে এই প্রত্যাশিত স্বপ্নটির অপমৃত্যু অনেকের মতো আমার হৃদয়েও রক্তক্ষরণ ঘটায়। সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকলেও আমার হৃদয়ের সিংহাসনে রাজনীতির যে জাগ্রত বিবেক অধিষ্ঠিত, সে আমাকে তাড়িত করে বলেই আমি নিবন্ধ লিখি, কথা বলি সত্যাশ্রয়ী হয়ে। কারো প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা শত্রুতা আমার নেই। তবুও আমার কথাগুলো প্রায় ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
দৈনিক মানবজমিন-এর প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্বাধিকারী জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী আমার অনুজপ্রতিম। তিনি আশৈশব ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। তিনি গণতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জীবিত একটা তেজোদ্দীপ্ত প্রাণ। ভ্রান্ত বামের বিপ্লবের বিলাস তার চেতনাকে কখনো আবৃত করেনি। নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে যখন একটা সশস্ত্র বিপ্লবের প্রসবযন্ত্রণায় ওই কল্পনাবিলাসী, রোমান্টিক বিপ্লবীরা স্লোগান তুলতেন- ‘বিপ্লব বিপ্লব, সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘নির্বাচন নির্বাচন, বর্জন বর্জন’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘নির্বাচনের কথা বলে যারা সিআই’র দালাল তারা’, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। আমি বলতে দ্বিধা করবো না, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় পরিষদে তখন আমি নিদারুণ সংখ্যালঘিষ্ঠ। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পরিষদের বর্ধিত সভায় কোন অবস্থাতেই ৭০’র নির্বাচনের স্বপক্ষে বিরতিহীন দীর্ঘ ৭২ ঘণ্টার বর্ধিত সভায় আমি প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পারি নি। ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে পল্টন ময়দানের বিশাল জনসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় দাঁড়িয়ে প্রস্তাবটির স্বপক্ষে শপথবাক্য উচ্চারণ করেছিলাম। পরবর্তীকালে সারা বাংলাদেশে বাউলের মতো, চারণ কবির মতো গণতন্ত্রের গান গেয়ে ফিরেছি। তেমনিভাবে হাছন রাজার দেশ সিলেটে জনসভা করতে গেলে মৌলভীবাজারে কিশোর মতিউরের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে স্বভাবসুলভভাবেই জিজ্ঞেস করেছিলাম- বিপ্লব চাও, না নির্বাচন চাও? কেন জানি না, সে বিনম্র স্বরে জবাব দিয়েছিল- নির্বাচন চাই। উত্তরটি আমাদের আশ্চর্যান্বিত করেছিল, বিস্মিত করেছিল। ভাবতেও পারি নাই সেই মতিউরই আজকের দৈনিক মানবজমিন-এর মালিক হবে, চ্যানেল আই’র আজকের সংবাদপত্র অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হবে, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলাদেশের প্রতিনিধি হবে। শুধু কি তাই! সাংবাদিকতার আরও কত শত আঙ্গিকে তার বলিষ্ঠ পদচারণা! শেখ ফজলুল হক মণির বাংলার বাণীতে মণি ভাইয়ের কাছে তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তা সত্ত্বেও দলীয় চেতনার ঊর্ধ্বে সাধারণ মানুষের গভীর মমত্ববোধে তার চিত্ত উদ্বেলিত ছিল। আমি যতদূর জানি, মতিউর সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। আর সেজন্যই তার কাছে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি আশা করা অমূলক নয়। সেদিন যে কিশোরটি নির্দ্বিধায় নির্বাচনের পক্ষে থাকার ঘোষণা দিতে পেরেছিল। আজকে দুই নেত্রীর ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রতিযোগিতায় দেশ যখন ক্রমেই গভীর অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অতলান্তে তলিয়ে যাচ্ছে তখন কেন সেই কিশোরটির কাছ থেকে আশা করবো না সাংবাদিকতার নির্ভীক ও সত্যাশ্রয়ী ভূমিকার? আজ জাতির বিভাজনের এই অপরাজনীতির বিরুদ্ধে কাউকে না কাউকে তো অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে। রাজনীতিতে শুধুই প্রাপ্তি-প্রত্যাশার হিসাব না কষে মানিক ভাই, সিরাজ ভাইয়ের মতো নির্ভীক সাংবাদিকতার অভয়বাণী কাউকে না কাউকে তো শোনাতেই হবে। মানবজমিন-এর ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সেটাই এই ঘন ঘোর অমানিশার দিনে মানবজমিন-এর কাছে আমার প্রত্যাশা ও দাবি।
আজকে সাংবাদিকতার চিত্রটা খোলনলচেসহ বদলে গেছে। গাড়িচাপা দিয়ে মানুষ মারলে আদালতের দেয়া শাস্তির বিরুদ্ধে আচমকা গাড়ির মালিক ও চালক সমিতি ধর্মঘট ডেকে মানুষের চরম ভোগান্তি ও জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করলে সংবাদপত্রের যে বস্তুনিষ্ঠ ও কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করা পেশাদারিত্বের খাতিরে উচিত ছিল, সেটা সুনির্দিষ্ট কারণে তারা নিতে পারেননি। পূর্বের মতো একযোগে পত্রিকাগুলো থেকে একই ভাষায় কোনো প্রতিবাদ আসেনি। আগে এমন পরিস্থিতিতে মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, সালাম খান- এ ধরনের জনদুর্ভোগে একযোগে একই ভাষায় একসাথে যার যার পত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশ করে জানান দিতেন দুষ্কর্মটির বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান শুধু প্রতিবাদমুখরই নয়, একাট্টা।
বর্তমানে একমাত্র প্রেস ক্লাব ছাড়া সাংবাদিকদের সকল সংগঠনই দু’টি ধারায় বিভক্ত। এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য আজকে প্রচণ্ড অন্তরায়। এদেশের মানুষ হতদরিদ্র হৃদয়ে বেদনাবিধুর চিত্তে সবই উপলদ্ধি করেন। তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণও হয়। যে জাগ্রত জনতা এই মার্চ মাসে উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালায় পাকিস্তানের সবকিছুকে ভাসিয়ে দিয়েছিল, তারাই আজ নীরব, নিথর, নিষ্প্রভ। তাদের ম্লান মূক মুখে ভাষা দেওয়ারও কেউ নাই। তাদের ভগ্নহৃদয়ে আশার বাণী ধ্বনিত করারও কেউ নাই। সাংবাদিক সমাজের এই বিভাজনের, আত্মকেন্দ্রিকতার ও আখের গোছানোর অকল্যাণকর মুহূর্তে দৈনিক মানবজমিন-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাদের শুভকামনা জানিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুলনায় হৃদয়টি চরম বিষাদে ভরে ওঠে।
সমাজের সর্বস্তরে, বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুধুই প্রাপ্তি-প্রত্যাশার হিসাব কষা, তাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দুর্দশা, অন্যদিকে সাংবাদিকদের নির্ভীক সত্য প্রকাশের অক্ষমতা অবলোকন করে আমার সমস্ত হৃদয়জুড়ে একটা কথাই মাথা কুটে মরে- এর জন্য তো স্বাধীনতা আনি নি! অযুত-নিযুত মানুষের বুকনিঃসৃত রক্তে আলিঙ্গন করা স্বাধীনতার সূর্য তার বিকীর্ণ অগ্নিকণায় সমস্ত হীনমন্যতার অন্ধকারকে দূর করে দিবে এই প্রত্যাশিত স্বপ্নটির অপমৃত্যু অনেকের মতো আমার হৃদয়েও রক্তক্ষরণ ঘটায়। সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকলেও আমার হৃদয়ের সিংহাসনে রাজনীতির যে জাগ্রত বিবেক অধিষ্ঠিত, সে আমাকে তাড়িত করে বলেই আমি নিবন্ধ লিখি, কথা বলি সত্যাশ্রয়ী হয়ে। কারো প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা শত্রুতা আমার নেই। তবুও আমার কথাগুলো প্রায় ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
দৈনিক মানবজমিন-এর প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্বাধিকারী জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী আমার অনুজপ্রতিম। তিনি আশৈশব ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। তিনি গণতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জীবিত একটা তেজোদ্দীপ্ত প্রাণ। ভ্রান্ত বামের বিপ্লবের বিলাস তার চেতনাকে কখনো আবৃত করেনি। নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে যখন একটা সশস্ত্র বিপ্লবের প্রসবযন্ত্রণায় ওই কল্পনাবিলাসী, রোমান্টিক বিপ্লবীরা স্লোগান তুলতেন- ‘বিপ্লব বিপ্লব, সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘নির্বাচন নির্বাচন, বর্জন বর্জন’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘নির্বাচনের কথা বলে যারা সিআই’র দালাল তারা’, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। আমি বলতে দ্বিধা করবো না, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় পরিষদে তখন আমি নিদারুণ সংখ্যালঘিষ্ঠ। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পরিষদের বর্ধিত সভায় কোন অবস্থাতেই ৭০’র নির্বাচনের স্বপক্ষে বিরতিহীন দীর্ঘ ৭২ ঘণ্টার বর্ধিত সভায় আমি প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পারি নি। ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে পল্টন ময়দানের বিশাল জনসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় দাঁড়িয়ে প্রস্তাবটির স্বপক্ষে শপথবাক্য উচ্চারণ করেছিলাম। পরবর্তীকালে সারা বাংলাদেশে বাউলের মতো, চারণ কবির মতো গণতন্ত্রের গান গেয়ে ফিরেছি। তেমনিভাবে হাছন রাজার দেশ সিলেটে জনসভা করতে গেলে মৌলভীবাজারে কিশোর মতিউরের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে স্বভাবসুলভভাবেই জিজ্ঞেস করেছিলাম- বিপ্লব চাও, না নির্বাচন চাও? কেন জানি না, সে বিনম্র স্বরে জবাব দিয়েছিল- নির্বাচন চাই। উত্তরটি আমাদের আশ্চর্যান্বিত করেছিল, বিস্মিত করেছিল। ভাবতেও পারি নাই সেই মতিউরই আজকের দৈনিক মানবজমিন-এর মালিক হবে, চ্যানেল আই’র আজকের সংবাদপত্র অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হবে, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলাদেশের প্রতিনিধি হবে। শুধু কি তাই! সাংবাদিকতার আরও কত শত আঙ্গিকে তার বলিষ্ঠ পদচারণা! শেখ ফজলুল হক মণির বাংলার বাণীতে মণি ভাইয়ের কাছে তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তা সত্ত্বেও দলীয় চেতনার ঊর্ধ্বে সাধারণ মানুষের গভীর মমত্ববোধে তার চিত্ত উদ্বেলিত ছিল। আমি যতদূর জানি, মতিউর সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। আর সেজন্যই তার কাছে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি আশা করা অমূলক নয়। সেদিন যে কিশোরটি নির্দ্বিধায় নির্বাচনের পক্ষে থাকার ঘোষণা দিতে পেরেছিল। আজকে দুই নেত্রীর ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রতিযোগিতায় দেশ যখন ক্রমেই গভীর অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অতলান্তে তলিয়ে যাচ্ছে তখন কেন সেই কিশোরটির কাছ থেকে আশা করবো না সাংবাদিকতার নির্ভীক ও সত্যাশ্রয়ী ভূমিকার? আজ জাতির বিভাজনের এই অপরাজনীতির বিরুদ্ধে কাউকে না কাউকে তো অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে। রাজনীতিতে শুধুই প্রাপ্তি-প্রত্যাশার হিসাব না কষে মানিক ভাই, সিরাজ ভাইয়ের মতো নির্ভীক সাংবাদিকতার অভয়বাণী কাউকে না কাউকে তো শোনাতেই হবে। মানবজমিন-এর ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সেটাই এই ঘন ঘোর অমানিশার দিনে মানবজমিন-এর কাছে আমার প্রত্যাশা ও দাবি।