ঢাকা; মুক্তিযোদ্ধা। ডাকসাইটে আমলা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। শিক্ষক ও গবেষক। আকবর আলি খান পরিচিতি পেয়েছেন বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবেও। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্র আর সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে প্রায়শই সরব হয়েছেন তিনি। কখনো মুখে বলে, কখনো লিখে। লেখক-গবেষক আকবর আলি খান তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত বই ‘অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির নানা সংকট আর সম্ভাবনাকে। শুধু সংকটের কথা বলেই থেমে থাকেননি তিনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাতলে দিয়েছেন সমাধানের পথও।
বইয়ের ফ্ল্যাপেই লেখা হয়েছে- রাজনৈতিক দিক থেকে জন্মলগ্নে বাংলাদেশ ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দুর্বার, উচ্ছল ও প্রাণবন্ত একটি দেশ। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল একটি দারিদ্র্যপীড়িত ও সমস্যা জর্জরিত রাষ্ট্র। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। অথচ আন্তর্জাতিক মানে দেশটিতে সুশাসনের প্রকট ঘাটতি রয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমাপে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপন্ন।
বইয়ের ভূমিকায় আকবর আলি খান লিখেছেন, উইনস্টন চার্চিলের ভাষায় বলতে গেলে বাংলাদেশ একটি রহস্যঘেরা প্রহেলিকাচ্ছন্ন হেঁয়ালি। একদিকে এখানে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রকট অপ্রতুলতা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে; অন্যদিকে সুশাসনে নিশ্চিত অবক্ষয় ঘটেছে। বাংলাদেশের অনেক অর্জনের জন্য আমি গর্বিত। তবু রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সুশাসনের ক্রমাগত অধোগতি আমার প্রজন্মের যারা আমার মতো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের জন্য দৈহিক যন্ত্রণার চেয়েও মর্মান্তিক মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছে। এই গ্রন্থের জন্ম এই যন্ত্রণাবোধ থেকেই।
গণতন্ত্রের বয়ান লিখতে গিয়ে আকবর আলি খান বলেছেন, এ কথা সত্য যে, গণতন্ত্র হলেই সব রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে না। তবে গণতন্ত্রের যেসব বিকল্প রয়েছে, সেসব ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি ত্রুটি রয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পাশ্চাত্য জগৎ থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে প্রাচীনকাল থেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু ছিল। বাংলাদেশ এ ব্যতিক্রমধর্মী রাষ্ট্রের মধ্যে একটি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ভারতের পূর্বাঞ্চলে শাসকদের নির্বাচিত করা হতো। আনুমানিক ৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পাল বংশের রাজা গোপাল সিংহাসনে বসেন। কিন্তু গোপাল গায়ের জোরে রাজা হননি, দেশের জনগণ তাকে রাজা করেছে।
গত চার দশকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করলে নিম্নলিখিত দুর্বলতাসমূহ সহজেই ধরা পড়ে। ক. অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থতা। অনেক নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচন শাসক দলের পাতানো খেলায় পর্যবসিত হয়। শুধু যেসব নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, সেসব নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃত হয়। খ. সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত নয় এমন সরকার কর্তৃক দেশ শাসন। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাংসদেরা নির্বাচিত হন। আনুপাতিক ভিত্তিতে নির্বাচন না হওয়ার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এরফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ সম্ভব হয় না। গ. প্রতিনিধিত্বশীল সরকারে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সমাধানের দায়িত্ব সাংসদদের। গণভোট বা ৎবভবৎবহফঁস-এর ব্যবস্থা না থাকাতে (শুধু সামরিক শাসকেরা তাদের শাসনকে বৈধ করার জন্য পাতানো গণভোটের ব্যবস্থা করেন) কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে জনমত যাচাই করা হয় না। রাজনীতিবিদেরা সাধারণত দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে বিরোধী দলের বক্তব্য কোনো কাজে লাগে না। বিরোধী দলের পক্ষে হরতাল দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠিত হলে হরতালের রাজনীতির প্রকোপ কমতে পারে। ঘ. জনমত অগ্রাহ্য করার অনুদার মূল্যবোধ। একদিনের নির্বাচনে জয়লাভ করলে পুরো মেয়াদে দেশ শাসন করা। এই ব্যবস্থার ফলে সরকার একবার নির্বাচনে জিতলে জনমতকে অগ্রাহ্য করে দেশ শাসন করতে পারে। ঙ. বাংলাদেশে অনুদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সংঘাতের রাজনীতিতে বিরোধী বক্তব্যের কোনো স্থান নেই। উদার গণতন্ত্র যেসব মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তার বেশির ভাগই বাংলাদেশে অনুপস্থিত। এখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত, নির্বাহী, বিচার ও সংসদের ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন নেই।
‘ভোটের খেল: সংখ্যালঘু নির্বাচিত সরকার ও একদিনের বাদশা’ শীর্ষক অধ্যায়ে আকবর আলি খান লিখেছেন, বৃটিশ নাট্যকার টম স্টপার সুন্দরভাবে বলেছেন, ‘শুধু ভোটের ব্যবস্থা থাকলেই গণতন্ত্র হয় না। ভোট কিভাবে হিসাব করা হবে, তার ওপরই নির্ভর করে ভোটের ফলাফল।’ গণতন্ত্রের ধারাটি অত্যন্ত সহজ কিন্তু অনেক সময় এর বাস্তবায়ন সহজ নয়। তত্ত্ব অনুসারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে না। আনুপাতিক হারে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আকবর আলি খান লিখেছেন, এটি প্রবর্তন করা হলে অনেকগুলো সুফল পাওয়া যাবে। প্রথমত, জাল-জালিয়াতির প্রবণতা দূর না হলেও অনেকাংশে হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক সংঘর্ষের তীব্রতা কমে আসবে। তবে এর একটি বড় অসুবিধা হলো, ভোটাররা আনুপাতিক হারে নির্বাচনকে গ্রহণ করতে রাজি নাও হতে পারেন। বর্তমান ব্যবস্থায় সব প্রার্থীকেই তার নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের সন্তুষ্ট করতে হয়। এরফলে ভোটার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভোটারদের সমস্যা সমাধানে এ সম্পর্ক অনেকটা কাজে লাগে। কাজেই নির্বাচনী এলাকা তুলে দেয়ার পক্ষে অধিকাংশ ভোটারই হয়তো মত দেবেন না।
আকবর আলি খান আরো লিখেছেন, সুষ্ঠু, অবাধ ও স্বাধীন নির্বাচন শুধু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়; মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এটি অত্যাবশ্যক। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে তাই সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘শুধু বিধি অনুসারে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ফল ঘোষণা করলেই তাকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন হলো সে নির্বাচন, যে নির্বাচনে হেরে যাওয়া দল এবং প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে উৎসাহী থাকে।’ বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যবশত এই সংজ্ঞা অনুসারে অনেক নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি।
আকবর আলি খানের জন্ম ১৯৪৪ সালে। ইতিহাসে অনার্স ও এমএ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি জান্তা সরকার তার অনুপস্থিতিতে তাকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থসচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ছিলেন আকবর আলি খান। ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। তার লেখা একাধিক গ্রন্থ বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
বইয়ের ফ্ল্যাপেই লেখা হয়েছে- রাজনৈতিক দিক থেকে জন্মলগ্নে বাংলাদেশ ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দুর্বার, উচ্ছল ও প্রাণবন্ত একটি দেশ। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল একটি দারিদ্র্যপীড়িত ও সমস্যা জর্জরিত রাষ্ট্র। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। অথচ আন্তর্জাতিক মানে দেশটিতে সুশাসনের প্রকট ঘাটতি রয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমাপে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপন্ন।
বইয়ের ভূমিকায় আকবর আলি খান লিখেছেন, উইনস্টন চার্চিলের ভাষায় বলতে গেলে বাংলাদেশ একটি রহস্যঘেরা প্রহেলিকাচ্ছন্ন হেঁয়ালি। একদিকে এখানে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রকট অপ্রতুলতা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে; অন্যদিকে সুশাসনে নিশ্চিত অবক্ষয় ঘটেছে। বাংলাদেশের অনেক অর্জনের জন্য আমি গর্বিত। তবু রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সুশাসনের ক্রমাগত অধোগতি আমার প্রজন্মের যারা আমার মতো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের জন্য দৈহিক যন্ত্রণার চেয়েও মর্মান্তিক মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছে। এই গ্রন্থের জন্ম এই যন্ত্রণাবোধ থেকেই।
গণতন্ত্রের বয়ান লিখতে গিয়ে আকবর আলি খান বলেছেন, এ কথা সত্য যে, গণতন্ত্র হলেই সব রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে না। তবে গণতন্ত্রের যেসব বিকল্প রয়েছে, সেসব ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি ত্রুটি রয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পাশ্চাত্য জগৎ থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে প্রাচীনকাল থেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু ছিল। বাংলাদেশ এ ব্যতিক্রমধর্মী রাষ্ট্রের মধ্যে একটি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ভারতের পূর্বাঞ্চলে শাসকদের নির্বাচিত করা হতো। আনুমানিক ৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পাল বংশের রাজা গোপাল সিংহাসনে বসেন। কিন্তু গোপাল গায়ের জোরে রাজা হননি, দেশের জনগণ তাকে রাজা করেছে।
গত চার দশকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করলে নিম্নলিখিত দুর্বলতাসমূহ সহজেই ধরা পড়ে। ক. অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থতা। অনেক নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচন শাসক দলের পাতানো খেলায় পর্যবসিত হয়। শুধু যেসব নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, সেসব নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃত হয়। খ. সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত নয় এমন সরকার কর্তৃক দেশ শাসন। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাংসদেরা নির্বাচিত হন। আনুপাতিক ভিত্তিতে নির্বাচন না হওয়ার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এরফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ সম্ভব হয় না। গ. প্রতিনিধিত্বশীল সরকারে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সমাধানের দায়িত্ব সাংসদদের। গণভোট বা ৎবভবৎবহফঁস-এর ব্যবস্থা না থাকাতে (শুধু সামরিক শাসকেরা তাদের শাসনকে বৈধ করার জন্য পাতানো গণভোটের ব্যবস্থা করেন) কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে জনমত যাচাই করা হয় না। রাজনীতিবিদেরা সাধারণত দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে বিরোধী দলের বক্তব্য কোনো কাজে লাগে না। বিরোধী দলের পক্ষে হরতাল দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠিত হলে হরতালের রাজনীতির প্রকোপ কমতে পারে। ঘ. জনমত অগ্রাহ্য করার অনুদার মূল্যবোধ। একদিনের নির্বাচনে জয়লাভ করলে পুরো মেয়াদে দেশ শাসন করা। এই ব্যবস্থার ফলে সরকার একবার নির্বাচনে জিতলে জনমতকে অগ্রাহ্য করে দেশ শাসন করতে পারে। ঙ. বাংলাদেশে অনুদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সংঘাতের রাজনীতিতে বিরোধী বক্তব্যের কোনো স্থান নেই। উদার গণতন্ত্র যেসব মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তার বেশির ভাগই বাংলাদেশে অনুপস্থিত। এখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত, নির্বাহী, বিচার ও সংসদের ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন নেই।
‘ভোটের খেল: সংখ্যালঘু নির্বাচিত সরকার ও একদিনের বাদশা’ শীর্ষক অধ্যায়ে আকবর আলি খান লিখেছেন, বৃটিশ নাট্যকার টম স্টপার সুন্দরভাবে বলেছেন, ‘শুধু ভোটের ব্যবস্থা থাকলেই গণতন্ত্র হয় না। ভোট কিভাবে হিসাব করা হবে, তার ওপরই নির্ভর করে ভোটের ফলাফল।’ গণতন্ত্রের ধারাটি অত্যন্ত সহজ কিন্তু অনেক সময় এর বাস্তবায়ন সহজ নয়। তত্ত্ব অনুসারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে না। আনুপাতিক হারে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আকবর আলি খান লিখেছেন, এটি প্রবর্তন করা হলে অনেকগুলো সুফল পাওয়া যাবে। প্রথমত, জাল-জালিয়াতির প্রবণতা দূর না হলেও অনেকাংশে হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক সংঘর্ষের তীব্রতা কমে আসবে। তবে এর একটি বড় অসুবিধা হলো, ভোটাররা আনুপাতিক হারে নির্বাচনকে গ্রহণ করতে রাজি নাও হতে পারেন। বর্তমান ব্যবস্থায় সব প্রার্থীকেই তার নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের সন্তুষ্ট করতে হয়। এরফলে ভোটার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভোটারদের সমস্যা সমাধানে এ সম্পর্ক অনেকটা কাজে লাগে। কাজেই নির্বাচনী এলাকা তুলে দেয়ার পক্ষে অধিকাংশ ভোটারই হয়তো মত দেবেন না।
আকবর আলি খান আরো লিখেছেন, সুষ্ঠু, অবাধ ও স্বাধীন নির্বাচন শুধু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়; মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এটি অত্যাবশ্যক। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে তাই সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘শুধু বিধি অনুসারে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ফল ঘোষণা করলেই তাকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন হলো সে নির্বাচন, যে নির্বাচনে হেরে যাওয়া দল এবং প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে উৎসাহী থাকে।’ বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যবশত এই সংজ্ঞা অনুসারে অনেক নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি।
আকবর আলি খানের জন্ম ১৯৪৪ সালে। ইতিহাসে অনার্স ও এমএ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি জান্তা সরকার তার অনুপস্থিতিতে তাকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থসচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ছিলেন আকবর আলি খান। ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। তার লেখা একাধিক গ্রন্থ বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।