সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও ব্রাজিলে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস আর নেই (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। বাংলাদেশ সময় গতকাল ভোর ৬টার দিকে ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়াতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওই কূটনীতিকের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক ও মন্ত্রণালয় আমেরিকাস অনুবিভাগের মহাপরিচালক আবিদা ইসলাম জানিয়েছেন, রাষ্ট্রদূত কায়েস দীর্ঘ সময় ধরে শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। মাসখানেক আগে তিনি ব্রাসিলিয়ার একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তার অবস্থার অবনতিতে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলেন তিনি। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালনকারী পেশাদার কূটনীতিক মিজারুল কায়েস তার বর্ণাঢ্য কূটনৈতিক জীবনে দেশ ও দেশের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। ঢাকায় থাকাকালে তিনি মহাপরিচালক হিসেবে সার্ক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অর্থনৈতিক বিষয়াবলি, আনক্লস ও বহিঃপ্রচার অনুবিভাগ দেখভাল করতেন। আর দেশের বাইরে তিনি বৃটেন ও মালদ্বীপের হাইকমিশনার ও রাশিয়াতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৪ সালে তিনি ব্রাজিলে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পান। কিশোরগঞ্জের সন্তান মিজারুল কায়েসের
মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৫৭ বছর। ব্যক্তিজীবনে তিনি স্ত্রী নাঈমা কায়েস চৌধুরী ও দুই মেয়ে মানসী কায়েস ও মাধুরী কায়েসকে রেখে গেছেন। মিজারুল কায়েসের মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকেও তার মৃত্যুতে শোক ও শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ডিকাব প্রেসিডেন্ট রেজাউল করিম লোটাস ও সাধারণ সম্পাদক পান্থ রহমানসহ বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা কূটনীতিক কাম সংগঠক কায়েসের মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টে পড়াশোনা করা মিজারুল কায়েস বিসিএসে ’৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ নানা পদে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটেও তিনি পড়িয়েছিলেন। শিল্পকলার একজন সমঝদার ব্যক্তি হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে মিজারুলের, চিত্রকর্ম সংগ্রহে তার ছিল বিশেষ ঝোঁক। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম বিস্তারে একজন সংগঠক হিসেবে তার ভূমিকা ছিল। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও চিত্র প্রদর্শনীতে বিচারকের ভূমিকা পালন করতেন খ্যাতিমান ওই কূটনীতিক। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সদস্যও ছিলেন তিনি। মিজারুল কায়েস পররাষ্ট্র সচিব থাকাকালে (২০১২ সালে) শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ও রক্তে ইনফেকশনের মতো প্রাণঘাতী সেপটেসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই সময়ে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন। পররাষ্ট্র সচিবের পদে তার ৩ বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন শেষে তাকে লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে পাঠায় সরকার। সেখানেও প্রায় বেশ কিছু দিন ছিলেন তিনি।
মরদেহ আসছে সোমবার: মিজারুল কায়েসের মরদেহ আনা এবং পরবর্তী দাফন প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গতকাল বিকালে মানবজমিনকে বলেন, তার মরদেহ ঢাকায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ব্রাজিলের কূটনৈতিক কমিউনিটিতে কিছু আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। এই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর ব্রাসিলিয়ার একটি মরচুয়ারিতে মরদেহ রাখা হবে। আগামী সোমবার নাগাদ তা বাংলাদেশে পৌঁছাবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ধারণা দিয়েছেন। ব্রাজিলে মিজারুল কায়েসের সঙ্গে তার স্ত্রী নাঈমা কায়েস এবং ছোট মেয়ে মাধুরী কায়েস থাকতেন। তারা মরদেহ নিয়ে দেশে ফিরবেন। তার বড় মেয়ে মানসী কায়েস লন্ডনে পড়ালেখা করেন। তিনিও ঢাকায় আসবেন। কূটনীতিক কায়েসের ভাই মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ ইমরুল কায়েস ঢাকায় রয়েছেন। পারিবারিক সিদ্ধান্তেই তার দাফনের পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে জানানো হয়েছে।
দেশ একজন পেশাদার কূটনীতিককে হারালো- প্রেসিডেন্ট: মোহাম্মদ মিজারুল কায়েসের মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বার্তায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বঙ্গভবনে পাঠানো শোক বার্তায় প্রেসিডেন্ট বলেন, মিজারুল কায়েসের মৃত্যুতে দেশ একজন পেশাদার কূটনীতিককে হারালো। মিজারুলের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তার শোকগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান প্রেসিডেন্ট।
ব্রাজিল সরকার ও রাষ্ট্রদূত নাব্রিগার শোক: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও ব্রাজিলে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ মিজারুল কায়েসের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত ওয়ানজা কম্পোস দ্য নাব্রিগা। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ব্রাজিল সরকারের পক্ষ থেকে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে জানাচ্ছি যে আমাদের দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মিজারুল কয়েস গতকাল (স্থানীয় সময় ১০ই মার্চ রাতে) ব্রাসিলিয়ায় মারা গেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে (রাষ্ট্রদূত নাব্রিগা) এবং ব্রাজিল সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূত কায়েসের মৃত্যুতে তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি গভীর শোক জানাচিচ্ছ।