নারী দিবসে কিছু টুকরো গল্প

Slider নারী ও শিশু সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী

85ac364bc25a4f98e5e90b63e8e9bdad-58be5a4b3a052

 

 

 

 

 

একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। গল্প হিসেবেই বলছি, তবে ঘটনাটি নির্মম সত্য। আমার এক চিকিৎসক বান্ধবীর বাস্তব অভিজ্ঞতা।

এক নারী সন্তান প্রসব করেছেন কিছুক্ষণ আগে। নবজাতক ছেলে ও মায়ের অবস্থা বেশ খারাপ। আমার চিকিৎসক বান্ধবী ওই নারীর স্বামীকে কিছু ওষুধ আনতে দেন। কিছু ওষুধ বাচ্চার জন্য আর কিছু ওষুধ ওই নারীর জন্য। কিছুক্ষণ পর স্বামী ওষুধ নিয়ে ফিরে আসেন, তবে শুধু শিশুটির প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো নিয়ে। চিকিৎসক যখন জানতে চান, মায়ের ওষুধগুলো কোথায়? তখন ওই ব্যক্তি বলেন, ‘ওর (স্ত্রীর) ওষুধ লাগবে না। ও এমনিতেই সেরে যাবে। বাচ্চাকে আগে দেখেন।’ আমার বান্ধবী বিষয়টি ধরতে পারলেন। তাঁকে বোঝালেন, সব ওষুধ বাচ্চার জন্যই ছিল। স্ত্রী ওই ওষুধগুলো খেলে তা বাচ্চার কাছেই যাবে। বাচ্চা মায়ের দুধ খাবে। বাচ্চার সমস্যা দূর হবে। সুস্থ হবে। এই ওষুধের এই সিস্টেম। তখন ওই ব্যক্তি অবাক হয়ে বললেন, ‘আগে বলবেন না বাচ্চার ওষুধ। তাহলে তো দেরি করতাম না।’

গল্পটা ছোট। হয়তো রসিকতা হিসেবে নেওয়া হতে পারে। কিন্তু আসলেই কি তাই? আমাদের দেশে সন্তান পালনের ক্ষেত্রে মা-বাবারা একটা মন্তব্য প্রায়ই করেন, তা হলো, তোমাদের মানুষ করতে ছেলেমেয়ের তফাত করিনি। এই বাক্যটিই বলে দেয় তফাত কী? সন্তান সন্তানই, কেন মনে হবে তফাত করা যায়, কেন মাথায় আসবে এখানে একটা তফাতের বিষয় থাকতে পারে।

আজকে চরম বিষয়গুলো বলছি না। বলছি না ভ্রূণহত্যার মতো নির্মম কিছু নিয়ে। সামান্য কিছু বিষয়, যা হয়তো আপনার মেয়েশিশুটির মনে দাগ কেটে আছে। সময় যায়, কিন্তু মেয়েটির মন থেকে বিষয়টি মোছে না। মিলিয়ে দেখতে পারেন, এমনটি কি ঘটে না?

অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর কোনো একটি বিষয় পছন্দ করে নিতে হয় শিক্ষার্থীদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেয়েটি মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও তাকে বলা হয় মানবিক বিভাগে পড়তে। কারণ, এই বিভাগে অপেক্ষাকৃত কম খরচ হয়। এ ছাড়া মনে করা হয় সহজ বিষয়, সহজে পাস করে যাবে। এভাবে অনেক মেয়েকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে দেওয়া হয় না। আমি বলব না সব সময় এমনটাই ঘটছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কি এই ঘটনা ঘটে না?

মিনা কার্টুনের গল্পগুলো কিন্তু বাস্তব থেকেই নেওয়া। ঘরের কাজগুলো করে মিনা। আর পড়াশোনা করে তার ভাই রাজু। কাজ মিলাতে গেলেই লেগে যায় হুলুস্থুল। খাবারের ভালো ও বড় অংশ পায় বাড়ির ছেলে। নিশ্চয় ভাবছেন, এ বাবা, আবার এখন মিনা কার্টুন তুলে আনল। এখন কি আর সেই অবস্থা আছে?

হুম্‌, হয়তো সীমিত কিছু পরিবারে এই বিষয়গুলো দেখা যায় না। কিন্তু মেয়েশিশুটিকে তো আমরা ছোট ছোট শখ থেকে বঞ্চিত করিই, যা এই জীবনে পূরণ হয় না। যেমন ধরুন, একটু বড় হলেই বন্ধ হয়ে যায় বাড়ির সামনের মাঠে খেলতে যাওয়া, বিকেল হলেই যাওয়া যাবে না ঘরের বাইরে, হয়তো বান্ধবীদের সঙ্গে এক রাত গল্প করে কাটানোর শখ আপনার মেয়েটির কোনো দিনও পূরণ হয় না, যা বাড়ির ছেলেশিশুটির জন্য প্রযোজ্য হয় না। বিদ্যালয়ের পিকনিক, মেয়েটিকে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। অথচ ছেলেটিকে ঠিকই যেতে দেওয়া হয়। যে পরিবারে ছেলেমেয়ে দুজনই আছে, এমন পরিবারে বিষয়টি মেয়েশিশুটির মনে বেশি প্রভাব ফেলে। ছেলেটি শেখে, আমার বোনকে নিরাপত্তার জন্য যেতে দেওয়া হয়নি। আমার মতে, দুজনকে যেত দেওয়া উচিত। ছেলেকে বোঝানো উচিত, তুমি যাও আর তোমার সহপাঠীদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখো। এভাবে পরিবার থেকে শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করা যায়। তথাকথিত নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কত কিছু থেকে যে মেয়েশিশুটিকে বঞ্চিত করা হয়। এরপর বাবার বাড়িতে চরম নিরাপত্তায় রেখে হঠাৎ করেই হয়তোবা একদম অজানা কারও সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় মেয়েটিকে। মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি যায় আরেকজনের আমানত হয়ে। মেয়েটির নিরাপত্তা পুরোপুরি নির্ভর করে স্বামী মানুষটি কেমন হবে, তার ওপর। আর মেয়েটির একসময়ের চরম নিরাপদ স্থান বাবার বাড়ি হয়ে যায় অতিথিশালা। নিজস্ব গণ্ডি, নিজস্ব ঘরটি ছেড়ে দিতে হয়। ঠিক আছে, বাস্তব প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, এমনটিই তো হওয়ার কথা…হয়ে আসছে। এ নিয়ে কথা বলা বাড়াবাড়ি।

কিন্তু শ্বশুরবাড়ি…মেয়েটির কি নিজের কিছু? ধরুন, মেয়টি বাপের বাড়িতে প্যান্ট-শার্ট পরত…শ্বশুরবাড়িতে তা তাঁকে বাদ দিতে হয়, মেয়েটি গান শুনতে ভালোবাসত, এখন বুঝতে হয় শ্বশুর কী ভাবছেন গান শুনলে। রান্না করতে গেলে বুঝে নিতে হয় শাশুড়ির বিষয়টি কেমন লাগছে। কারণ, হেঁশেলটি যে শাশুড়ির বড় আপন। এমন কত কিছু।

আরেকটা গল্প বলি। আমার পরিচিত একটি মেয়ে, যে ভালো চাকরি করত, নিজের চাহিদা নিজেই মেটাতে পারত। বিয়ে হলো…আমি ‘বিয়ে করল’ বললাম না, কারণ পরিবার থেকে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হলো। বিয়ের পর চাকরি ছাড়ল। খুবই সাধারণ বিষয়। এমনটাই হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। তবে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল ওই দিন, যেদিন ও বলল, ‘যখন বাথরুমে যাই, শ্বশুর আশপাশে ঘোরাফেরা করেন। পানি কতটুকু খরচ করছি, তা বোঝার চেষ্টা করেন। বেশি পানি খরচ হলে উনি রাগ করেন, বলেন….লাট সাহেবের বেটি।’

এভাবেই চলছে। সবাই এগুলোকে স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছে। তবে সব ক্ষেত্রেই যে এমন ঘটছে, তা নয়।

নারী দিবস, বছরে বছরে আসে, দিনটিতে সবাই সোচ্চার হন। কোথাও কোথাও সভা হয়। হয় কিছু ফুল বিনিময়। শ্রদ্ধার কথা আসে মুখে মুখে। এক সময় দিনটা শেষ হয়ে যায়। পরের দিন ফুলগুলো শুকিয়ে যায়। উদ্‌যাপনকারীরা ভাবেন, বেশ ভালোই কাটল এবারের দিবসটি। পরিবর্তন হয় না তেমন কিছু। হলেও বড়ই কষ্টকরভাবে, ধীরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *