ঢাকা; বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির কড়া সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বলেছে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, খেয়াল-খুশিমতো ও বেআইনি গ্রেপ্তার এবং গুম বাংলাদেশে মানবাধিকারের প্রধান অন্তরায়। এছাড়া, রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতা, সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি, অনলাইন ও মিডিয়ায় মুক্ত মত প্রকাশে বাধা।
বাংলাদেশে ২০১৬ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নিজস্ব ওয়েবসাইটে সারা বিশ্বের গত বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। শুক্রবার প্রকাশিত রিপোর্টের বাংলাদেশবিষয়ক অধ্যায়ও বেশ দীর্ঘ, ৫৭ পৃষ্ঠার। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ, বহু মতবাদ ও সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচন আন্তর্জাতিক বেশির ভাগ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে বিতর্কিত ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে পারেনি।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর ওপর বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। দায়েশ ও আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট (একিউআইএস) তাদের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশে। হত্যা করা হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, শিক্ষাবিদ, বিদেশি, মানবাধিকার কর্মী, এলজিবিটি সম্প্রদায়ের সদস্য ও অন্যান্য গ্রুপের সদস্যদের। সরকার জঙ্গিবিরোধী শক্তিশালী অভিযান চালিয়েছে। তবে মানবাধিকারবিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ঘুষ আদায়ের জন্য খেয়াল-খুশি মতো গ্রেপ্তার, গুম, নির্যাতন ও মানবাধিকারের আরো লঙ্ঘন হচ্ছে।
সুশীল ও রাজনৈতিক অধিকারকে সীমিত করতে সরকার সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ আরো বেশি ব্যবহার করেছে। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, খেয়াল-খুশি মতো ও বেআইনি গ্রেপ্তার, গুমের জন্য দায়ী নিরাপত্তা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো। কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এমন গ্রুপের হাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের হত্যা বেড়েছে। রয়েছে বাল্যবিয়ে ও জোরপূর্বক বিয়ে, লিঙ্গগত সহিংসতা- বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ওপর। কর্মক্ষেত্রে রয়েছে নাজুক পরিস্থিতি ও শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার ওই রিপোর্টে আরো বলেছে, কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকারকে সঙ্কুচিত করেছে। কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান (এনজিও) অব্যাহতভাবে আইনি ও অনানুষ্ঠানিক বিধি-নিষেধের মুখোমুখি হয়েছে। বিকলাঙ্গদের বিরুদ্ধে বৈষম্য রয়েছে। বিশেষ করে বিকলাঙ্গ কোনো শিশু সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা নিয়ম লঙ্ঘন বা নির্যাতনের ক্ষেত্রে ব্যাপক দায়মুক্তি পাচ্ছেন বলে রিপোর্ট পাওয়া গেছে।
নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত ও দোষীদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সরকার সীমিত পদক্ষেপ নিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কট্টরপন্থিদের হামলার শিকারদের দায়ী করেছে সরকার। এতে হামলাকারীরা দায়মুক্তি পেয়েছে এবং এমনটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বন্দি বা আটক করা হয়েছে অনেক মানুষকে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি এমন কিছু ‘ভুল’ অভিযোগ সহ বিরোধী দলগুলোর সদস্যদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা হয়েছে বলে দৃশ্যমান। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত শহীদদের সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য করার কারণে সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে তাকে গ্রেপ্তার করে নি সরকার। বিরোধী দলীয় সদস্যরা দাবি করেছেন, জুনের শুরুতে গণগ্রেপ্তার চালায় সরকার। এ সময় নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা তাদের প্রায় ২০০০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে, যদিও তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয় নি বা জেল দেয়া হয় নি। এর মধ্যে কিছু মানুষ উৎকোচ দিয়ে মুক্তি পেয়েছেন।
ওই রিপোর্টে বলা হয় মিডিয়া, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো রিপোর্ট করেছে যে, সরকার অথবা তার এজেন্টরা অনেক খেয়াল-খুশি মতো ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ঘেরাও, গ্রেপ্তার ও আইনপ্রয়োগকারীদের অভিযানের সময়ও অনেক সন্দেহজনক মৃত্যু হয়েছে। মাঝে মধ্যেই নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা বলে থাকেন, হেফাজতে থাকা সন্দেহভাজনকে নিয়ে তারা শেষ রাতের দিকে অপরাধের ঘটনাস্থলে অভিযানে যান অস্ত্র উদ্ধারে অথবা ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে। তখনই সন্দেহভাজনের দোসররা গুলি চালায়। এতে সন্দেহভাজন নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ডকে সরকার যথারীতি ক্রসফায়ারে হত্যা, গানফাইট অথবা এনকাউন্টারে হত্যা বলে বর্ণনা করে। অপরাধী চক্রের সঙ্গে র্যাব ও পুলিশ সদস্যদের গুলিবিনিময়ের ঘটনাকে এভাবেই বর্ণনা করা হয়, যদিও মিডিয়া মাঝে মধ্যেই এসব শব্দকে পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া হিসেবে বর্ণনা করে। মানবাধিকার সংগঠন ও বিভিন্ন মিডিয়া এসব ক্রসফায়ারের অনেকগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে বর্ণনা করে।
একটি মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম ৯ মাসে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ১৫০ জন। এর মধ্যে ৩৪ জন নিহত হয়েছেন র্যাবের হাতে, ১১ জন ডিবি পুলিশের হাতে, একজন বিজিবির হাতে, ৩ জন নিহত হয়েছেন যৌথ সোয়াত অভিযানের সময় এবং ৬১ জন নিহত হয়েছেন পুলিশ বাহিনীর হাতে। অন্য একটি মানবাধিকার সংগঠনের মতে, গত বছর প্রথম ৯ মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ১১৮ জন।
এতে বলা হয়েছে, মানবাধিকারবিষয়ক গ্রুপগুলো ও মিডিয়া রিপোর্ট করেছে অনেক গুম, অপহরণের ঘটনা ঘটেছে গত বছর। এর মধ্যে অনেকগুলো ঘটিয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। এমন কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বা তদন্তে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সীমিত। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ৯ই মার্চ যোগাযোগ করে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস। তারা বাংলাদেশে গুম বৃদ্ধির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে। কিন্তু ওয়ার্কিং গ্রুপ কোনো জবাব পায় নি।
গুমের অভিযোগের পর নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা কিছু মানুষকে অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি দেয় অথবা কিছু মানুষকে গ্রেপ্তার দেখায়। আবার কিছু মানুষকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। আবার অন্যদের আর কোনোদিন খুঁজেই পাওয়া যায় না। মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠনের মতে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক পরিচয় দানকারীরা বছরের প্রথম ১১ মাসে ৮৪ জনকে ‘অপহরণ’ করেছে। টার্গেট করে গুমের মধ্যে রয়েছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা।
রিপোর্টে বলা হয়, বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের ওপর সরকার নিয়মিত নজরদারি চালিয়েছে। পুলিশ ক্ষেত্রবিশেষে বিচারিক বা অন্য কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত গৃহে প্রবেশ করেছে।
মত প্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অংশে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার অধিকার অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, কর্তৃপক্ষ মাঝে মধ্যে এ অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক সাংবাদিক হেনস্তা ও প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে সরকারের সমালোচনায় স্ব-সেন্সরশিপ আরোপ করেন।
এতে আরো বলা হয়, সংবিধানে সংবিধান সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সমতুল্য করেছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া, টিভি ব্যক্তিত্ব মাহমুদুর রহমান মান্না, সাংবাদিক কনক সরওয়ার সহ বেশ কয়েকজন হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ রয়েছে। আইনানুযায়ী ‘হেট স্পিচ’ সীমিত করা হয়েছে, তবে কী কী ‘হেট স্পিচে’র অন্তর্ভুক্ত তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। কোনো বক্তব্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অন্য দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সমপর্ক, জনশৃঙ্খলা, শিষ্টাচার ও নৈতিকতার বিরুদ্ধে গেছে বলে সরকার মনে করলে তা সীমিত করা যাবে।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়া সক্রিয় ও বিভিন্ন মত প্রকাশ করতে পেরেছে, কিন্তু যেসব মিডিয়া আউটলেট সরকারের সমালোচনা করেছে সেগুলোকে সরকারের নেতিবাচক চাপ সহ্য করতে হয়েছে। কিছু সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন যে, বিভিন্ন কোমপানি ও সরকারের বিজ্ঞাপন আটকে দিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মিডিয়াকে প্রভাবিত করেছে। সাংবাদিকদের শারীরিক নির্যাতন, হেনস্তা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। রিপোর্টে ডেইলি স্টারের সমপাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে শাসক দলের নেতাকর্মীদের দায়ের করা বিপুল মামলার কথা উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে একজন টকশো উপস্থাপকের প্রসঙ্গও এসেছে। বলা হয়েছে, তিনি একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের তরফ থেকে সেন্সরশিপ আরোপের শিকার হন। মালিক পক্ষ ওই টকশো বন্ধ করে দেয়ার আগ পর্যন্ত তারা ওই উপস্থাপক ও টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি দিয়েছিলো। পরে ওই উপস্থাপক আরেকটি টকশোতে কাজ চালিয়ে গেলে, সেখানেও নিরাপত্তা বাহিনী থেকে তাকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়। এছাড়া, তার ওপর নজরদারি চালানো সহ তাকে এসএমএস, চিঠি ও ফোনে হত্যার হুমকি দেয়া হয়।
রিপোর্টে বিএনপি-সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত সমপাদককে আটকের কথা উল্লেখ করা হয়। এতে ৮১ বছর বয়সী সাংবাদিক শফিক রেহমান, আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সমপাদক মাহমুদুর রহমানকে আটকের কথা বলা হয়। সেন্সরশিপের কথা উল্লেখ করে এতে বলা হয়, ব্যক্তিমালিকানাধীন সংবাদপত্রগুলো স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমের মালিকানা রাজনীতি প্রভাবিত। সরকার ও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞাপনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। সরকার পরোক্ষভাবে হুমকি ও হয়রানির মাধ্যমে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে, ব্যক্তিমালিকানাধীন টিভি চ্যানেলকে বিরোধীদলীয় কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য প্রচার না করতে বলেছে। বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছ থেকে হুমকি পাওয়া, সংবাদমাধ্যমের ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ সহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে এসেছে মার্কিন সরকারের এই প্রতিবেদনে।
নির্বাচনী ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে গত বছর অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে হওয়া সহিংসতার কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা বিরোধী দল ও স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বিভাগে বলা হয়, সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামর্থ্যের অনেকখানি ব্যবহার করেছে বিরোধী দলের নেতাদের দমাতে।
এছাড়া আরো যেসব বিষয়ের ওপর এতে আলোকপাত করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ইন্টারনেট স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠন করার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, অভিবাসী ও শরণার্থীদের নির্যাতন, বিদেশ ভ্রমণে বাধা, সরকারে দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি তদন্তের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, মানবপাচার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, লিঙ্গ বৈষম্য, শ্রমিক অধিকার, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম সহ বহু বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
সুশীল ও রাজনৈতিক অধিকারকে সীমিত করতে সরকার সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ আরো বেশি ব্যবহার করেছে। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, খেয়াল-খুশি মতো ও বেআইনি গ্রেপ্তার, গুমের জন্য দায়ী নিরাপত্তা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো। কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এমন গ্রুপের হাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের হত্যা বেড়েছে। রয়েছে বাল্যবিয়ে ও জোরপূর্বক বিয়ে, লিঙ্গগত সহিংসতা- বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ওপর। কর্মক্ষেত্রে রয়েছে নাজুক পরিস্থিতি ও শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার ওই রিপোর্টে আরো বলেছে, কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকারকে সঙ্কুচিত করেছে। কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান (এনজিও) অব্যাহতভাবে আইনি ও অনানুষ্ঠানিক বিধি-নিষেধের মুখোমুখি হয়েছে। বিকলাঙ্গদের বিরুদ্ধে বৈষম্য রয়েছে। বিশেষ করে বিকলাঙ্গ কোনো শিশু সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা নিয়ম লঙ্ঘন বা নির্যাতনের ক্ষেত্রে ব্যাপক দায়মুক্তি পাচ্ছেন বলে রিপোর্ট পাওয়া গেছে।
নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত ও দোষীদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সরকার সীমিত পদক্ষেপ নিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কট্টরপন্থিদের হামলার শিকারদের দায়ী করেছে সরকার। এতে হামলাকারীরা দায়মুক্তি পেয়েছে এবং এমনটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বন্দি বা আটক করা হয়েছে অনেক মানুষকে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি এমন কিছু ‘ভুল’ অভিযোগ সহ বিরোধী দলগুলোর সদস্যদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা হয়েছে বলে দৃশ্যমান। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত শহীদদের সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য করার কারণে সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে তাকে গ্রেপ্তার করে নি সরকার। বিরোধী দলীয় সদস্যরা দাবি করেছেন, জুনের শুরুতে গণগ্রেপ্তার চালায় সরকার। এ সময় নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা তাদের প্রায় ২০০০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে, যদিও তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয় নি বা জেল দেয়া হয় নি। এর মধ্যে কিছু মানুষ উৎকোচ দিয়ে মুক্তি পেয়েছেন।
ওই রিপোর্টে বলা হয় মিডিয়া, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো রিপোর্ট করেছে যে, সরকার অথবা তার এজেন্টরা অনেক খেয়াল-খুশি মতো ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ঘেরাও, গ্রেপ্তার ও আইনপ্রয়োগকারীদের অভিযানের সময়ও অনেক সন্দেহজনক মৃত্যু হয়েছে। মাঝে মধ্যেই নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা বলে থাকেন, হেফাজতে থাকা সন্দেহভাজনকে নিয়ে তারা শেষ রাতের দিকে অপরাধের ঘটনাস্থলে অভিযানে যান অস্ত্র উদ্ধারে অথবা ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে। তখনই সন্দেহভাজনের দোসররা গুলি চালায়। এতে সন্দেহভাজন নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ডকে সরকার যথারীতি ক্রসফায়ারে হত্যা, গানফাইট অথবা এনকাউন্টারে হত্যা বলে বর্ণনা করে। অপরাধী চক্রের সঙ্গে র্যাব ও পুলিশ সদস্যদের গুলিবিনিময়ের ঘটনাকে এভাবেই বর্ণনা করা হয়, যদিও মিডিয়া মাঝে মধ্যেই এসব শব্দকে পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া হিসেবে বর্ণনা করে। মানবাধিকার সংগঠন ও বিভিন্ন মিডিয়া এসব ক্রসফায়ারের অনেকগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে বর্ণনা করে।
একটি মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম ৯ মাসে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ১৫০ জন। এর মধ্যে ৩৪ জন নিহত হয়েছেন র্যাবের হাতে, ১১ জন ডিবি পুলিশের হাতে, একজন বিজিবির হাতে, ৩ জন নিহত হয়েছেন যৌথ সোয়াত অভিযানের সময় এবং ৬১ জন নিহত হয়েছেন পুলিশ বাহিনীর হাতে। অন্য একটি মানবাধিকার সংগঠনের মতে, গত বছর প্রথম ৯ মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ১১৮ জন।
এতে বলা হয়েছে, মানবাধিকারবিষয়ক গ্রুপগুলো ও মিডিয়া রিপোর্ট করেছে অনেক গুম, অপহরণের ঘটনা ঘটেছে গত বছর। এর মধ্যে অনেকগুলো ঘটিয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। এমন কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বা তদন্তে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সীমিত। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ৯ই মার্চ যোগাযোগ করে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস। তারা বাংলাদেশে গুম বৃদ্ধির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে। কিন্তু ওয়ার্কিং গ্রুপ কোনো জবাব পায় নি।
গুমের অভিযোগের পর নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা কিছু মানুষকে অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি দেয় অথবা কিছু মানুষকে গ্রেপ্তার দেখায়। আবার কিছু মানুষকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। আবার অন্যদের আর কোনোদিন খুঁজেই পাওয়া যায় না। মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠনের মতে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক পরিচয় দানকারীরা বছরের প্রথম ১১ মাসে ৮৪ জনকে ‘অপহরণ’ করেছে। টার্গেট করে গুমের মধ্যে রয়েছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা।
রিপোর্টে বলা হয়, বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের ওপর সরকার নিয়মিত নজরদারি চালিয়েছে। পুলিশ ক্ষেত্রবিশেষে বিচারিক বা অন্য কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত গৃহে প্রবেশ করেছে।
মত প্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অংশে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার অধিকার অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, কর্তৃপক্ষ মাঝে মধ্যে এ অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক সাংবাদিক হেনস্তা ও প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে সরকারের সমালোচনায় স্ব-সেন্সরশিপ আরোপ করেন।
এতে আরো বলা হয়, সংবিধানে সংবিধান সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সমতুল্য করেছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া, টিভি ব্যক্তিত্ব মাহমুদুর রহমান মান্না, সাংবাদিক কনক সরওয়ার সহ বেশ কয়েকজন হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ রয়েছে। আইনানুযায়ী ‘হেট স্পিচ’ সীমিত করা হয়েছে, তবে কী কী ‘হেট স্পিচে’র অন্তর্ভুক্ত তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। কোনো বক্তব্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অন্য দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সমপর্ক, জনশৃঙ্খলা, শিষ্টাচার ও নৈতিকতার বিরুদ্ধে গেছে বলে সরকার মনে করলে তা সীমিত করা যাবে।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়া সক্রিয় ও বিভিন্ন মত প্রকাশ করতে পেরেছে, কিন্তু যেসব মিডিয়া আউটলেট সরকারের সমালোচনা করেছে সেগুলোকে সরকারের নেতিবাচক চাপ সহ্য করতে হয়েছে। কিছু সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন যে, বিভিন্ন কোমপানি ও সরকারের বিজ্ঞাপন আটকে দিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মিডিয়াকে প্রভাবিত করেছে। সাংবাদিকদের শারীরিক নির্যাতন, হেনস্তা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। রিপোর্টে ডেইলি স্টারের সমপাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে শাসক দলের নেতাকর্মীদের দায়ের করা বিপুল মামলার কথা উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে একজন টকশো উপস্থাপকের প্রসঙ্গও এসেছে। বলা হয়েছে, তিনি একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের তরফ থেকে সেন্সরশিপ আরোপের শিকার হন। মালিক পক্ষ ওই টকশো বন্ধ করে দেয়ার আগ পর্যন্ত তারা ওই উপস্থাপক ও টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি দিয়েছিলো। পরে ওই উপস্থাপক আরেকটি টকশোতে কাজ চালিয়ে গেলে, সেখানেও নিরাপত্তা বাহিনী থেকে তাকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়। এছাড়া, তার ওপর নজরদারি চালানো সহ তাকে এসএমএস, চিঠি ও ফোনে হত্যার হুমকি দেয়া হয়।
রিপোর্টে বিএনপি-সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত সমপাদককে আটকের কথা উল্লেখ করা হয়। এতে ৮১ বছর বয়সী সাংবাদিক শফিক রেহমান, আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সমপাদক মাহমুদুর রহমানকে আটকের কথা বলা হয়। সেন্সরশিপের কথা উল্লেখ করে এতে বলা হয়, ব্যক্তিমালিকানাধীন সংবাদপত্রগুলো স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমের মালিকানা রাজনীতি প্রভাবিত। সরকার ও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞাপনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। সরকার পরোক্ষভাবে হুমকি ও হয়রানির মাধ্যমে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে, ব্যক্তিমালিকানাধীন টিভি চ্যানেলকে বিরোধীদলীয় কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য প্রচার না করতে বলেছে। বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছ থেকে হুমকি পাওয়া, সংবাদমাধ্যমের ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ সহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে এসেছে মার্কিন সরকারের এই প্রতিবেদনে।
নির্বাচনী ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে গত বছর অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে হওয়া সহিংসতার কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা বিরোধী দল ও স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বিভাগে বলা হয়, সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামর্থ্যের অনেকখানি ব্যবহার করেছে বিরোধী দলের নেতাদের দমাতে।
এছাড়া আরো যেসব বিষয়ের ওপর এতে আলোকপাত করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ইন্টারনেট স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠন করার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, অভিবাসী ও শরণার্থীদের নির্যাতন, বিদেশ ভ্রমণে বাধা, সরকারে দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি তদন্তের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, মানবপাচার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, লিঙ্গ বৈষম্য, শ্রমিক অধিকার, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম সহ বহু বিষয়ে আলোচনা করা হয়।