অমর একুশ আজ বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পালিত হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় তা পেয়েছে নতুন মাত্রা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শহীদ দিবস পালনে লেবাননের চিত্র একটু অন্যরকম। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এই আরব দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের পদচারণার চার দশক পূর্ণ হলেও এখানে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া শুরু হয়েছে ২০১৬ সাল থেকে।
প্রবাসী বাংলাদেশি বাবু সাহা লেবাননে আছেন প্রায় ২০ বছর। লেবাননের বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে বৈরুতে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি ও প্রভাতফেরির আয়োজনের প্রসঙ্গে আবেগপূর্ণ কণ্ঠে তিনি বলেন, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের প্রতি তার নিজের ভালোবাসার মাত্রা দূতাবাসের উদ্যোগে নির্মিত শহীদ মিনারে ফুল দিতে এসে তিনি নতুন করে অনুভব করেন। তিনি আরও বলেন, বিদেশের মাটিতে নির্মিত শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার মাঝে এত আনন্দ আছে আগে বুঝিনি। দূতাবাস প্রাঙ্গণে মাইকে বাজছে একুশের অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’’ আর আমি ফুল দিচ্ছি। যখন বেদিতে ফুল দিলাম, আমার নিজের মাঝে এক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। এ ভালো লাগা বলে বোঝাতে পারব না। দূতাবাসে অস্থায়ীভাবে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেবার জন্য রাষ্ট্রদূতকে ধন্যবাদ জানাই।
এ বছর লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়েছে দুই পর্বে। প্রথম পর্বে ছিল প্রভাতফেরি। ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ফোটেনি। বাংলাদেশ দূতাবাসের ছাদে শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি ফুল হাতে জড়ো হয়েছেন। তাদের বেশ কয়েকজনকে খালি পায়েও দেখা গেল। সকাল সাতটায় লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকার সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেন। এরপর দূতাবাসের ছাদে অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
দ্বিতীয় পর্বে ছিল আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি রোববার। ২১ ফেব্রুয়ারি লেবাননে কর্মদিবস থাকায় অধিক সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশির অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য এই পর্বটি রোববার আয়োজন করা হয়। প্রথমে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর মহান ভাষাশহীদের প্রতি সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। নীরবতার পর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ করা হয়। এ ছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে কয়েকজন বক্তব্য প্রদান করেন।
সমাপনী বক্তব্যে আবদুল মোতালেব সরকার বলেন, একুশ কেবল একটি দিন নয়, একুশ একটি চেতনা। একুশ আমাদের গর্ব, একুশ আমাদের অহংকার। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, একুশ আমাদের শিখিয়েছে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করতে। প্রকৃতপক্ষে একুশই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বাঙালি জাতি যে ইতিহাস রচনা করেছিল তা আজ সারা বিশ্ব স্মরণ করছে পরম শ্রদ্ধায়। ১৯৫২ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত যে দিনটি ছিল বাঙালি জাতির একান্ত নিজস্ব, তা আজ হয়ে গেছে সারা বিশ্বের সকলের। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
রাষ্ট্রদূত প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে আরও বেশ কয়টি বড় রকমের অনুষ্ঠান করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। তিনি আগামী পয়লা বৈশাখে বড় পরিসরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
সাংস্কৃতিক পর্বে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণে ১৩টি দেশাত্মবোধক গান, কবিতা ও কোরাস পরিবেশন করা হয়। এ পর্বে অন্যতম আকর্ষণ ছিল রাষ্ট্রদূতের কবিতা আবৃত্তি। তিনি কবি মহাদেব সাহার একুশের গান কবিতাটি আবৃত্তি করেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে মহসিন, শাহজাহান, রনি, ইমতিয়াজ, শাহরিয়ার, আবু সাঈদ, আঁখি, জেসমিন, আশিক মাহমুদ ও দিদারুল আলমসহ আরও বেশ কয়েকজন অংশগ্রহণ করেন। প্রবাসী শাহজাহানের গান সকলকে মুগ্ধ করে।