যেভাবে তথ্য মেলে: পুলিশ সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, ৩১ ডিসেম্বর সাংসদ মনজুরুল হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের ধরতে ১০ হাজারের বেশি মোবাইল ফোনের কল লিস্ট ও খুদে বার্তা পর্যালোচনা করে পুলিশ। এসব পর্যালোচনায় চন্দন সরকার নামের স্থানীয় এক সাংবাদিকের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হয়। তাঁর ফোনে আড়ি পাতার পাশাপাশি কয়েকজন দুষ্কৃতকারীর ব্যাপারে খোঁজখবর করে পুলিশ। একপর্যায়ে তাঁরা জানতে পারেন, মনজুরুল হত্যার এক মাস আগে ওই এলাকায় একটি দামি মোবাইল ফোনসেট ছিনতাই হয়। ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিভর্তি একটি ম্যাগাজিন ফেলে যায়।
গাইবান্ধা-১ আসনের উপনির্বাচনের দিন ঠিক হওয়ার পর পুলিশ বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু করে। তখন কাদের খান তাঁর নামে লাইসেন্স করা একটি পিস্তল ও একটি শটগান লোক মারফত থানায় জমা দেন। এর মধ্যে পিস্তলের ম্যাগাজিন খোয়া গেছে বলে জানান। পুলিশ জানতে পারে, তাঁর নামে ৫০টি গুলি ইস্যু করা থাকলেও ৪০টির হদিস নেই। ছিনতাইকারীদের ফেলে যাওয়া ম্যাগাজিনই তাঁর পিস্তলের বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়।
কয়েক দিন পর পুলিশ জানতে পারে, ফোনে কথা বলা তিনজনই কাদের খানের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি কাদেরের গাড়িতে করে যাওয়ার পথে সুন্দরগঞ্জ থেকে মেহেদী হাসান, শাহিন মিয়া ও কাদেরের গাড়িচালক হান্নানকে আটক করে পুলিশ। গত মঙ্গলবার এই তিনজনই ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তাঁরা নিজেদের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেন।
জানতে চাইলে ব্যারিস্টার শামীম হোসেন পাটোয়ারী বলেন, ‘কাদের খান আমাকে মারতে চেয়েছিলেন এমন কথা আমি পুলিশের কাছ থেকে শোনার আগে ভাবতেও পারিনি। কারণ, কাদের খানের সঙ্গে কখনো কোনো বিরোধ ছিল না।’ তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির কোনো কমিটিতেই এখন কোনো পদে নেই কাদের খান। এমনকি কোনো ইউনিয়ন কমিটিতেও তাঁর পদ নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সাংসদ মনজুরুল হত্যার পরে আমাদের আলোচনায় কখনো কাদের খানের নাম আসেনি।’
জবানবন্দিতে তিনজন যা বলেছেন: গাইবান্ধার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম মইনুল হাসান ইউসুবের আদালতে মঙ্গলবার মেহেদী, শাহিন মিয়া ও হান্নান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। হান্নানের বাড়ি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়া গ্রামে। রাশেদুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসান (২২) ও শাহিনের (২৩) বাড়ি সুন্দরগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নের উত্তর সমস কবিরাজটারি গ্রামে।
আদালত ও পুলিশ সূত্র বলেছে, জবানবন্দিতে ওই তিনজন বলেন, মনজুরুল হত্যার ছয়-সাত মাস আগে থেকে, অর্থাৎ মে মাসের দিকে কাদের খান তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি সাংসদ হওয়ার ইচ্ছা উল্লেখ করে তাঁদের বলেন, পথের কাঁটা লিটনকে (মনজুরুল) সরিয়ে দিতে হবে। পরিকল্পনামতো তাঁরা মনজুরুলকে হত্যার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে গত বছরের ২৭ অক্টোবর ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে তাঁরা মনজুরুলকে হত্যার জন্য ওত পেতে ছিলেন। কিন্তু তিনি সেদিন ওই পথে যাননি।
মেহেদী জবানবন্দিতে বলেন, হত্যাকাণ্ডের ১৫ দিন আগে তাঁরা মনজুরুলের গ্রামের বাড়ি সুন্দরগঞ্জের ছাপারহাটির একটি ধানের চাতালে অবস্থান নেন। সেখানে তিনি, শাহিন ও রানা থাকতেন। কাদের খানের গাড়িচালক হান্নান তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। ওই চাতালে থাকার সময় তাঁরা নিয়মিত অস্ত্র চালানোর চর্চা করতেন। চাতালের আশপাশের গ্রামের অনেক লোক তাঁদের দেখে সন্দেহ করেন। মনজুরুলকে হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে তাঁরা কয়েক দিন ওই এলাকায় রেকি করেন। একদিন কাদের খানও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
জানতে চাইলে ছাপারহাটি গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ মিয়া বলেন, তিনজন অচেনা লোককে তাঁরা চাতালে দেখেছেন। মনজুরুল খুনের পর তাঁদের আর দেখেননি।
শাহিন জবানবন্দিতে বলেন, ঘটনার দিন তিনি ও মেহেদী গাইবান্ধা শহরে ছিলেন। কাদের খান তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গাড়িতে করে শহর থেকে তুলে নেন আর রানাকে নেন কদমতলা থেকে। বিকেল চারটার দিকে তাঁরা কাদেরের সুন্দরগঞ্জের বাড়িতে যান। তাঁদের বাড়িতে বসিয়ে রেখে কাদের স্থানীয় সাংবাদিক চন্দনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। চন্দন তাঁকে মনজুরুলের বাড়িতে অবস্থান নিশ্চিত করেন। এরপর কাদেরের দেওয়া একটি মোটরসাইকেলে করে তাঁরা মনজুরুলের গ্রামের বাড়িতে যান। তিনজনের হাতে তিনটি অস্ত্র ছিল। প্রথমে রানা ও তিনি মনজুরুলের বাড়িতে ঢোকেন। এরপর মেহেদী ঢুকেই গুলি শুরু করেন। তখন তাঁরাও দুটি করে গুলি করেন। খুন করে পালানোর সময় তাঁর মাথায় থাকা ক্যাপ পড়ে যায়। ক্যাপটি ছিল মেহেদীর। মেহেদীর মাথায় হেলমেট থাকায় তিনি ক্যাপটি পরেছিলেন। খুনের পর তাঁরা কাদেরের বাড়িতে যান। এরপর হান্নান তাঁদের নিয়ে বগুড়ায় চলে আসেন। সেখান থেকে রাত দেড়টার আগমনী পরিবহনে তাঁদের তুলে দেওয়া হয়। হান্নান বাসের টিকিট নেন কাদেরের নামে। পুলিশ সেই টিকিট জব্দ করে।
শাহিন জবানবন্দীতে আরও বলেন, খুনের জন্য তাঁদের সাত লাখ টাকা দেওয়া হয়। তিনি ও রানা দুই লাখ করে ও মেহেদী তিন লাখ টাকা নেন। কথা ছিল, কাদের সাংসদ হলে তাঁদের একটি পেট্রল পাম্প করে দেবেন।
রংপুর ব্যাুরো জানায়, জাপার চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ গতকাল রংপুরে সাংবাদিকদের বলেন, আবদুল কাদের খান জাপার কেউ নন। তিন বছর ধরে কাদেরের সঙ্গে তাঁর ও দলের কোনো যোগাযোগ নেই। দলের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
রংপুর পর্যটন মোটেলে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার জাপার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এরশাদ এসব কথা বলেন। এ সময় এরশাদের সঙ্গে থাকা দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার সাংবাদিকদের বলেন, আবদুল কাদের একসময় জাতীয় পার্টির সাংসদ ছিলেন। দলের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তিন বছর ধরে দলের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই, সম্পর্ক নেই।