৩৭ নং বেচারাম দেউড়ি—-শফিক রেহমান

Slider ফুলজান বিবির বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

197492_172

কজন মারা গেছে তুই শুনেছিস?

একটু চুপ করো তোমরা। সন্ধ্যার খবর এখুনি হবে।
ও শুনে লাভ নেই। সত্যি খবর করাচি থেকে বলবে না।
কজন মারা গেছে তুই শুনেছিস?
সাইলেন্স। খবর।

রেডিও পাকিস্তান। খবর বলছি। আজ ঢাকায় আইন ও শৃঙ্খলা অমান্যকারী এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী একদল উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র ও জনতা শান্তিরক্ষাকারী পুলিশকে আক্রমণ করে। ফলে পুলিশ দল আত্মরক্ষার্থে আক্রমণকারী জনতার ওপরে প্রথমে লাঠি এবং পরে টিয়ার গ্যাস প্রয়োগ করে। অবস্থার আরো অবনতি ঘটলে পুলিশ দল কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করতে বাধ্য হয়। সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, এই সংঘর্ষে দুই ব্যক্তি নিহত এবং ৫৭ ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এই ৫৭ ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে সাইত্রিশ পুলিশ। আজ ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-

বন্ধ করো। বন্ধ করো।
লায়ার্স। মিথ্যা কথা প্রচারের একটা সীমা থাকা উচিত।
তত্ত্বকথা রাখো। চল। ওদের ঢাকা স্টেশন আজ জ্বালিয়ে দিয়ে আসি।
কজন মারা গেছে তুই শুনেছিস?
শুনলি তো দু’জন। মাত্র দু’জন। আমি নাজমা রেস্টুরেন্টের ভেতরে ছিলাম। নিজের চোখে দেখেছি ফার্স্ট রাউন্ডে ডজনখানেককে পড়ে যেতে। মেডিক্যাল হোস্টেলের ঠিক বাইরে।
হোস্টেলের মধ্যেও মারা গেছে। একজন নাকি তার নতুন বৌকে চিঠি লিখছিল। চাটাইয়ের বেড়ার হোস্টেল। ওর বাইরে কি, আর ভেতরে কি।
এই। আমাকে দু’টো টান দিতে দিস।
আনতে পাঠিয়েছি সিগারেট।
চায়ের কথা বলেছিস?
বলেছিলাম। হবে না। আনসার রেস্টুরেন্টের ছোকরা সারা দিন মিছিলে ছিল। এখনো নাকি ফেরেনি। চা চাইলে ওখানে গিয়ে খেতে হবে।
বাদ দে।
কজন মারা গেছে, তুই শুনেছিস?
আমি জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না। আমার চোখের সামনে শুধু ভাসছে লাল রক্ত। হলদে চাটাইয়ের ওপর, শাদা সিঁড়ির ওপর, কালো পিচের ওপর। ওদের সব সরিয়ে নিয়ে গেল পুলিশরা। হাতগুলো ঝুলছিল। কিন্তু সেই লাল রক্ত রয়ে গেল। আমি জানি না। আমি কিছু জানি না।
এই। ওকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না।
এখন সেই লাল রক্ত নিশ্চয়ই কালো হয়ে গিয়েছে। আমি দেখেছি। জবাই করা মুরগির লাল রক্ত আমাদের বাড়ির ড্রেনে আস্তে আস্তে কালো হয়ে যায়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। এখন কালো হয়ে গিয়েছে। আর কিছু তোমাকে বলতে হবে না। এখানটায় শোও তুমি। আমি আর কি বলবো? আমি তো কিচ্ছু জানি না। উঃ। ভীষণ শীত করছে।
জানালাটা বন্ধ করে দিচ্ছি।
না। জানালা বন্ধ করিস না। আমরা ঘরে – এতো লোক সিগারেট খাচ্ছি। কম্বলটা বরং চাপিয়ে দে ওর ওপর।
দিচ্ছি। এ কি! এর তো জ্বর এসে গেছে দেখছি! তাই এতো শীত।
ও কিছু না। শকে ওরকম হয়েছে। ঘুমিয়ে যেতে দে ওকে। ঠিক হয়ে যাবে।
কজন মারা গেছে তুই শুনেছিস?
মেডিক্যালের মর্গ নাকি বোঝাই হয়ে গিয়েছে। আর এক ট্রাক লাশ নিয়ে গেছে ক্যান্টনমেন্টে।
ক্যান্টনমেন্টে?
হ্যাঁ। ওখানে ওরা লাশগুলো পুড়িয়ে ফেলবে।
আর মেডিক্যালের লাশগুলো?
ওগুলো বোধহয় আর ক্যান্টনমেন্টে পাচার করতে পারবে না।
কেন?
মেডিক্যালের ছাত্ররা নজর রেখেছে শুনলাম।
সেই লাশ নিয়ে আগামীকাল সকালে তো আবার প্রসেশন হওয়ার কথা। তাই না?
তাই তো সবই বলাবলি করছিল। কিন্তু লাশ নাকি দেবে না।
আমিও তাই শুনেছি। আজ রাত তিনটার দিকে মৃতের আত্মীয়দের হাসপাতালে এসে লাশ শনাক্ত করে যেতে হবে এবং রাতারাতি কবর দিতে হবে। কাল সকালে কোনো লাশ কাউকে দেয়া হবে না।
লাশ ছাড়াই তাহলে প্রসেশন হবে।
তা হবে। আজকের চাইতে অনেক বড় প্রসেশন হবে।
কজন মারা গেছে তুই শুনেছিস?
সারা সন্ধ্যা ধরে তুই এই একই প্রশ্ন করছিস কেন? দশ, বিশ, পঞ্চাশ, এক শ’, হাজার লোক আরো মারা যাবে। আজকের রক্ত এখন কালো হয়ে গিয়েছে। কালকে ধুলো হয়ে যাবে। আবার রক্ত দিতে হবে। প্রতি বছরেই দিতে হবে। তারপর প্রতি মাসে। প্রতি দিনে। ওই যে গাছ। ওকে বড় করতে লেগেছে অনেক পানি। আর একটি জাতিকে বড় করতে লাগে অঢেল রক্ত।
এই যে সিগারেট।

প্রথম প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-তে

* ৩৭ নং বেচারাম দেউড়ি ছিল ঢাকা কলেজের হোটেল সুপার অধ্যাপক সাইদুর রহমানের বাসা। এই বাসায় ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত ছাত্রনেতারা আশ্রয় নিতেন। একুশে ফেব্রুয়ারি মিছিলে অংশ নিয়ে বাসায় ফিরে তাৎক্ষণিকভাবে লেখক এই লেখাটি লেখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *