ভাষাসংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি

Slider শিক্ষা সারাদেশ

ab62d23f5ab4cd54ed05a7ae0820a3f5-ZKS_9690

ঢাকা; টিএসসি পেরিয়ে শহীদ মিনারের কাছে পৌঁছে দেখি ব্যারিকেড। ২০ ফেব্রুয়ারি বেলা একটায় আমাদের মাইক্রোবাস দুটি সেখানে থেমে গেল।

দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাকে জানাই, আমাদের সঙ্গে আছেন দুজন বর্ষীয়ান ভাষাসংগ্রামী। জানাই, ৯২ বছরে পড়া ডা. সাঈদ হায়দার
ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনারের নকশাকার আর তিরাশি বছরের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়ার পাশাপাশি আন্দোলনের মূল ছবিগুলো তুলে ঠাঁই করে নিয়েছেন ইতিহাসে।

কিছুক্ষণের জন্য শহীদ মিনারে যাওয়ার অনুমতি মিলে যায়। ‘ধন্যবাদ’ বলে আমরা পৌঁছে যাই সেখানে। ঝাড়পোঁছ হয়ে গেছে শহীদ মিনার। পড়েছে রঙের প্রলেপ।

কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম শহীদ মিনারে। এখানেই দুই ভাষাসংগ্রামীর কাছ থেকে শুনব তাঁদের কথা। বয়স হয়েছে তাঁদের। কিন্তু ভাষা বা ভাবনায় আসেনি অসংলগ্নতা।

তাঁরা দুজনেই আলাপের শুরুতে বললেন, ভাষা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের।

সাঈদ হায়দার বললেন, ‘১৯৫২ সালে যে আন্দোলনটা হয়েছিল, তার পুরোভাগে ছাত্ররাই ছিল।’

রফিকুল ইসলাম তাঁর কথাকে আরও পরিষ্কার করে বললেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো তো ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষেই ছিল না। ছাত্ররাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে।’

সাঈদ হায়দার আক্ষেপ করে বললেন, ‘কথাটা এই যে আমরা ছাত্ররা এক ছিলাম, যেটা আজকাল দেখতে পাই না।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্রী সাকিয়া হক স্বীকার করে নিলেন কথাটা, ‘আমাদের মধ্যেই স্যার এখন অনেক অনেক ভাগ।’

সাঈদ হায়দার বললেন, ‘সে জন্যই বলি, যদি আন্দোলন হয় বা পরিবর্তন করার কথা মনে হয়, তবে সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হবে। ঐক্যটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।’

সমস্যার কথা নিয়ে এলেন রফিকুল ইসলাম, ‘দেখো, রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংবিধানস্বীকৃত। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রচলন তো নেই কোথাও। নতুন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব তো ছাত্রসমাজেরই। ওরাই তো প্রশ্ন তুলবে, কেন আমাদের দোকানপাটের নাম ইংরেজি হরফে হবে?’

বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন সাঈদ হায়দার, ‘রফিক ভাই বলতে চাইছেন, ভাষা আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে কিন্তু ভাষাসংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। সে সংগ্রামটা তোমাদের চালিয়ে নিতে হবে।’

তাঁদের আক্ষেপের কথা এল এভাবে, ‘এই যে আমাদের এখন যেসব সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, বউভাত, গায়েহলুদ, জন্মদিন—সমস্ত আমন্ত্রণপত্র কিন্তু ইংরেজিতে লেখা। উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষা এখনো প্রবেশ করতে পারল না। কী ধরনের একটা সামাজিক হীনম্মন্যতা! অথচ পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে আমরা বাংলা প্রচলন প্রায় করে ফেলেছিলাম।’

‘একটা দোকানের সাইনবোর্ডও ইংরেজিতে লেখা ছিল না।

‘এসব আমন্ত্রণপত্র বাংলায় দেওয়া হতো। গাড়ির নম্বরপ্লেট পর্যন্ত বাংলায় লেখা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সাংবাদিক এবিএম মূসা তাঁর গাড়ির নম্বরপ্লেট বদলে নিয়ে প্রথম বাংলা করলেন।

‘তবে তোমরা ভেবো না যে আমরা ইংরেজি বা উর্দুর বিপক্ষে ছিলাম। আমরা সব ভাষাকেই সম্মান করি। কিন্তু আমাদের যে অর্জন তা যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তা পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব তোমাদেরই।

‘হ্যাঁ, এটা বড় দুর্ভাগ্যজনক যে পাকিস্তান আমলে আমরা যতটা অর্জন করেছিলাম, স্বাধীনতার চার দশক পরে এসে দেখি যে সেগুলো নেই। এটা পরিবর্তন করা যাবে সামাজিক হীনম্মন্যতা দূর হলে। আবার বলি, এই সামাজিক হীনম্মন্যতা দূর করতে পারে আমাদের তরুণসমাজ।’

তারপরও তাঁরা যে হতাশ নন, তা বোঝা যায় সাঈদ হায়দারের কথায়, ‘আমরা কিন্তু আশাবাদী। এটা হবে যদি এখনকার তরুণসমাজ সচেতন হয়।

ইডেন মহিলা কলেজের আছমা আকতারের সরল জিজ্ঞাসা, ‘সচেতন কীভাবে হব?’

রফিকুল ইসলাম দেন উত্তর, ‘এ জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তোমরা তো সবাই চাও, বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলিত হোক?’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের দুই শিক্ষার্থী জেরিন শাইমা ও ফখরুল ইসলাম জানিয়ে দেন, এ বিষয়ে কোনো দ্বিধা নেই তাঁদের মনে।

 তারপর ওঁদের বলা হয়, ‘একটা বিদেশি ভাষা শেখার সঙ্গে কিন্তু মাতৃভাষার কোনো বিরোধ নেই। একজন মানুষ যত বেশি ভাষা শিখবে, তত বেশি জ্ঞানী বা সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু তা মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত। ওগুলো ওই অঞ্চলের মাতৃভাষা। আমরা যখন সবাই একসঙ্গে হব, তখন সাধারণ্যে কথা বলব প্রমিত বাংলা ব্যবহার করে। এবং শুদ্ধ উচ্চারণ করতে হবে।’

রফিকুল ইসলাম হেসে বললেন, ‘একটু আগে তোমাদের একজন বলছিল “করতেসি”, আমি বললাম, “করতেসি” না “করছি”।’

শিক্ষার্থীদের একজন বলল, ‘স্যার, এই ভাষাটা মিশে গেসে…’

বলার পরই মেয়েটা ওর ভুল বুঝতে পারল। বেশ একটু হাসাহাসি হয়ে গেল।

সাঈদ হায়দার বললেন, ‘মিশে গেসে না মিশে গেছে। তোমাদের সচেতন হতে হবে। বাড়িতে তুমি যা-ই বলো…’

তাঁকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়িতে তো বাড়ির ভাষা বলবে, বাজারে বলবে বাজারের ভাষা, পথে পথের ভাষায় কথা বলবে। কিন্তু ক্লাসরুমে, বেতারে…দ্যাখো, এফএম রেডিওতে বলা হচ্ছে এখন একটা সং শুনব। সং-এর কি কোনো বাংলা নেই আমাদের? আমরা কি কোনো দিন গান শুনিনি?’

একটু বিরতি দেওয়া হয়। অনেকক্ষণ তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন। দুটো চেয়ার জোগাড় হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা এখন অতীতের কথা শোনার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ‘স্যার, আমরা জানি আপনি ভাষা আন্দোলনের ছবি তুলেছিলেন’ রফিকুল ইসলামকে জেরিনের প্রশ্ন।

‘তখন খুব কম লোকের হাতে ক্যামেরা ছিল। সুযোগ-সুবিধামতো কিছু ছবি তুলেছি। আমি ছবি তুলেছিলাম কলাভবনের ওপর থেকে।’

এরপর তাঁরা ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা করলেন। ১৯৪৮ সালে প্রথম যে পাকিস্তান গণপরিষদের যে অধিবেশন হয়, সেখানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তান গণপরিষদের ভাষা উর্দু হবে বলে যে প্রস্তাব আনেন, তার বিপরীতে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর সঙ্গে বাংলার কথাও বলেছিলেন। হাসতে হাসতে রফিকুল ইসলাম বললেন, ‘মানুষের মুখের ভাষা পাকিস্তান গণপরিষদে স্থান পেল না। ফলে কি হলো জানো, গণপরিষদের অধিবেশন শেষে সদস্যরা যখন করাচি, দিল্লি, কলকাতা হয়ে ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজে ঢাকায় ফিরে এলেন, তখন এয়ারপোর্টে আমাদের প্রত্যেকের হাতেই জুতো। আমরা মুসলিম লীগ সদস্যদের জুতো দিয়ে আর ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলাম।’

এরপর তো মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা আগমন। এরপর ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীনের ঘোষণা ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রফিকুল ইসলাম বললেন, ‘আমরা কিন্তু পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকেই হরতাল, শোভাযাত্রা শুরু করলাম। ৪ তারিখে আমাদের প্রথম সভা হলো আমতলায়। ইতিমধ্যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়ে গেছে। ৪ তারিখে সিদ্ধান্ত হলো, ২১ তারিখে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসবে এবং ওই দিনই আমরা রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করব, হরতাল হবে এবং আমরা স্মারকলিপি দেব।’

এরপরের ইতিহাস সবার জানা। তারপরও শিক্ষার্থীরা নিমগ্ন হয়ে শুনতে থাকে। ভাষাসংগ্রামীরা শুরুতেই বলেছিলেন, ভাষা আন্দোলন শেষ হয়েছে কিন্তু ভাষাসংগ্রাম শেষ হয়নি। এ কথাটা নতুন প্রজন্মের তরুণেরা বুঝতে পারে। বিদায়ের সময় ওরা জানিয়ে দেয়, এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি ওদের জন্য নতুন এক অনুভূতি আর ভালোবাসা নিয়ে আসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *