সুন্দরীশূন্য হয়ে পড়ছে সুন্দরবন

Slider

5f14483c8543d88a00708e1e43a9f933-17

ঢাকা; সুন্দরবনের মতোই এই বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরীগাছ বিপদে। ধারাবাহিকভাবে লবণাক্ততা বাড়ায় বনের এই বৃক্ষটির পরিমাণ কমে আসছে। বাড়ছে অপেক্ষাকৃত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এমন বৃক্ষ গেওয়া, বাইন ও গরান। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা আরও বাড়বে। ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বনের বেশির ভাগ স্থান সুন্দরীগাছশূন্য হয়ে যাবে।
সুন্দরবনের ওপরে পরিচালিত বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। গত রোববার বিশ্বব্যাংক তাদের ওয়েবসাইটে সুন্দরবন বিষয়ে মোট তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশের ওপর সম্মিলিতভাবে ওই গবেষণা করা হয়। সুন্দরবনের মাটি ও পানি পরীক্ষা করে এবং ভূ-উপগ্রহ থেকে নেওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে।
গবেষণায় সুন্দরবনসংলগ্ন পাঁচটি উপজেলার লবণাক্ততার পরিমাণ এবং গাছের ধরনের মূল্যায়ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই এলাকাগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর মাছ ও শ্বাসমূলীয় গাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার প্রভাবকে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে সুন্দরবনসংলগ্ন পাঁচটি উপজেলা খুলনার কয়রা ও দাকোপ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলার বৃক্ষরাজির ওপরে জরিপ করা হয়। তাতে দেখা গেছে, সত্তরের দশকের পর থেকে ওই তিন উপজেলায় সুন্দরীগাছের পরিমাণ ক্রমাগত কমছে। বাড়ছে লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এমন বৃক্ষ কেওড়া, বাইন, গেওয়া ও গরান। এই বৃক্ষগুলো মূলত জ্বালানি কাঠ হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। এর কার্বন শোষণক্ষমতা ও অক্সিজেন উৎপাদনের ক্ষমতাও কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দাকোপের ৫১ শতাংশ এলাকায় গেওয়া ও বাইন বৃক্ষের বন। মোংলার বনভূমির ৫৩ শতাংশ গেওয়া, শ্যামনগরে ৯৮ শতাংশ গরান বৃক্ষ। একসময় দাকোপের বেশির ভাগ এলাকায় সুন্দরীগাছ থাকলেও তা বর্তমানে কমে প্রায় ৩৪ শতাংশ, কয়রার ৩২ শতাংশ ও মোংলায় ২৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

প্রতিবেদনটিতে সুন্দরবনে লবণাক্ততা বাড়ার কারণ হিসেবে গঙ্গা নদী থেকে সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কথা একটি স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। সুপারিশ হিসেবে প্রতিবেদনে সুন্দরবন রক্ষার আঞ্চলিক উদ্যোগগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততা বাড়ার বিষয়টি যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাবেক প্রধান সংরক্ষক ইউনুছ আলী  বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যেসব নদী বয়ে গেছে, তার বেশির ভাগের উৎস গঙ্গা অববাহিকা। গঙ্গার উজানে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ায় বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো সুন্দরবনে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে, যার প্রভাবে এখানে সুন্দরীর মতো মিষ্টি পানিনির্ভর বৃক্ষ কমে আসছে।

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন তিনটিতে বলা হয়েছে, সুন্দরবনে লবণাক্ততা বাড়ার প্রভাব পড়বে এটির মৎস্য সম্পদের ওপরেও। সুন্দরবনের নদী ও খালগুলোতে মিষ্টি পানিনির্ভর যেসব মাছ আছে, তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে পারে। ফলে এসব মাছ সংগ্রহ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে যেসব দরিদ্র জেলে সম্প্রদায়, তারা বিপদে পড়বে।

সুন্দরবনে লবণ ও মিষ্টি পানির মিশ্রণ (ব্র্যাকিশ ওয়াটার) মাছের তুলনায় মিষ্টি পানির মাছের পরিমাণ প্রায় ছয় গুণ বেশি। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এমনিতেই অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন সেই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

প্রতিবেদনটি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে গবেষণা দুটির প্রধান এবং বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ অর্থনীতি বিভাগের প্রধান সুস্মিতা সেনগুপ্তা বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় যেসব
আঞ্চলিক চুক্তি রয়েছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বা লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সুন্দরবনের প্রতিবেশব্যবস্থাকে রক্ষা করতে সবগুলো প্রভাবককেই আমলে নিতে হবে।

গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক সোবহান ও সংস্থাটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের বিশেষজ্ঞ ডেভিড হুইলার।

সুন্দরবনের চারপাশের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী দরিদ্র উল্লেখ করে গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, ওই জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা প্রায় এক কোটি, যাদের মধ্যে ৬০ লাখ অধিবাসী হতদরিদ্র। এদের জীবিকার প্রধান উৎস উচ্চ ফলনশীল ফসলের চাষ ও মাছ সংগ্রহ। লবণাক্ততা বাড়ায় স্থানীয় দরিদ্রদের আয় কমে যাবে, তাদের আমিষের প্রধান উৎস মাছ পাবে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *