ঐক্যের বদলে বিভক্তির সুর ট্রাম্পের

Slider সারাবিশ্ব

21b8d534a4c9b0b42f1b194644cf7396-trump111

ঢাকা; শুক্রবার ওয়াশিংটন ডিসিতে সবার নজর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের প্রতি। একদিন পর শনিবার মার্কিন রাজধানীর চেহারা সম্পূর্ণ বদলে যায়। কয়েক লাখ মানুষ, যাদের অধিকাংশই নারী এক অভূতপূর্ব ‘নারী পদযাত্রায়‘ অংশ নিতে এই শহরে সমবেত হয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন এদের অনেকে চোখে অবৈধ। যেসব নীতিমালা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি ট্রাম্প দিয়েছেন, এরা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই দেশের বিভিন্ন শহর থেকে জড়ো হয়।

শুক্রবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর ট্রাম্প যে ভাষণ দেন, তা থেকে স্পষ্ট নির্বাচনী প্রচারণার সময় যে বিভক্তি ও হতাশাকে পুঁজি করে তিনি হিলারি ক্লিনটনকে পরাস্ত করেন, সে রণকৌশল তিনি ত্যাগ করবেন না। এই ভাষণে ট্রাম্প আমেরিকার এক গভীর দুর্দশাগ্রস্ত চিত্র তুলে ধরেন, যেখানে দেশজুড়ে চলছে অব্যাহত হত্যাকাণ্ড, শহরতলিতে শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, অপরাধ ও মাদকাসক্তিতে তরুণদের জীবন বিপর্যস্ত। সারা দেশের কল-কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, সেগুলো দেখে মনে হয় যেন এক সমাধিক্ষেত্র। তিনি ঘোষণা দেন, এই রক্তপাত তিনি শেষ করবেন যার শুরু হলো এই মুহূর্ত থেকে।

ওয়াশিংটনের রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করে ট্রাম্প বলেন, এরা নিজেদের পকেট ভারী করেছে, কিন্তু দেশের নাগরিকদের রক্ষা করেনি। সারা দেশের অভাবগ্রস্ত পরিবারের জন্য কোনো বিজয় তারা আনতে পারেনি। তিনি ঘোষণা করেন, নির্বাচনে তাঁর বিজয়ের ভেতর দিয়ে রাজনীতিবিদদের হাত থেকে ওয়াশিংটন মার্কিন জনগণের হাতে তুলে দেওয়া হলো। তিনি আশ্বাস দেন, আমেরিকা আবারও মহান হবে। এখন থেকে আমেরিকা আর হারবে না, সে একের পর এক বিজয় ছিনিয়ে আনবে।

একাধিক ভাষ্যকার মন্তব্য করেছেন, যে বিধ্বস্ত ও পরাজিত আমেরিকার ছবি ট্রাম্প তাঁর ভাষণে চিত্রিত করেন, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। আমেরিকা এখনো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও সবচেয়ে শক্তিধর পরাশক্তি। ২০০৮ সালের পর আমেরিকা যে মন্দাবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়, বারাক ওবামার শাসনকালের বিগত আট বছরে মার্কিন অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে। এক বিপর্যয়কারী মন্দাবস্থা কাটিয়ে দেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন শুরু করেছে, এক কোটির অধিক নতুন সংস্থান হয়েছে, বেকারত্বের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প, ওবামার সব অর্জনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরেও তাঁর পুরোনো সে দাবি ত্যাগ করেননি।

ট্রাম্পের ভাষণের অন্য বৈশিষ্ট্য ছিল তার আন্তর্জাতিকতাবাদ-বিরোধিতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আমেরিকার বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রে ছিল বিশ্বশক্তি হিসেবে তার প্রবল উপস্থিতি। কিন্তু ট্রাম্প এক ভিন্ন, অন্তর্মুখী আমেরিকার কথা বলেন, যার একমাত্র লক্ষ্য হবে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিসহ সব প্রশ্নে জাতীয় স্বার্থকে তুলে ধরা। ‘আমাদের থাকবে দুটি সাধারণ নীতি, আমেরিকায় তৈরি জিনিস ক্রয় কর, আমেরিকানদের চাকরি দাও।’ এ সময় তিনি একাধিকবার ‘আমেরিকা ফার্স্ট, আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান উচ্চারণ করেন।

ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে যে কয়েক লাখ মানুষ ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়, তাদের অধিকাংশই ছিল শ্বেতকায়, যাদের ভোটে তাঁর এই অভাবিত বিজয় সম্ভব হয়। অভিষেক ভাষণে ট্রাম্প তাদের কথা মাথায় রেখেই প্রতিশ্রুতি দেন, এত দিন রাজনীতিবিদেরা যাদের ভুলে থেকেছে ও উপেক্ষা করেছে, তারা আর উপেক্ষিত থাকবে না। ট্রাম্প তাঁর ভাষণে একাধিকবার ‘তোমরা’ কথাটি ব্যবহার করেন। এই ‘তোমরা’র মধ্যে ছিল না কোনো অভিবাসী, কোনো মুসলিম বা এমনকি কোনো আফ্রিকান-আমেরিকান। এ দিন সন্ধ্যায় যে তিনটি বল নৃত্যে তিনি অংশ নেন, সেখানেও উপস্থিত দর্শকদের দিকে আঙুল তুলে তিনি বারবার বলেন, ‘তোমাদের জন্যই এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের জন্ম হয়েছে।’ প্রতিটি বল নৃত্যের প্রায় সব দর্শকই ছিল শ্বেতকায় ও আমেরিকার ধনাঢ্য শ্রেণির।

একাধিক ভাষ্যকার ট্রাম্পের ভাষণে ও প্রস্তাবিত নীতিতে বিভক্তির যে সুর রয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এর আগে অন্য কোনো প্রেসিডেন্ট অভিষেক ভাষণে নিজের দেশকে এভাবে পরাজিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত, বিপর্যস্ত ও আশাহীন বলে বর্ণনা করেননি। সুপরিচিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক এজরা ক্লাইন বারাক ওবামার প্রথম অভিষেক ভাষণের কথা স্মরণ করে লিখেছেন, ওবামা যেখানে মার্কিন নাগরিকদের ঐক্যের ভেতরে শক্তির সন্ধান করেছিলেন, ট্রাম্প সেখানে বিভক্তির ভেতরে নিজের জন্য ক্ষমতা খুঁজে পেয়েছেন। প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত মাদার জোন্স পত্রিকার ভাষ্যকার ডেভিড কর্ন দুঃখ করে লিখেছেন, ট্রাম্প এখনো ঘৃণা ও বিভক্তির পথ অনুসরণ করে চলেছেন।

বিশিষ্ট লেখক ক্রেইগশার্লি ওয়াশিংটন পোস্টের কাছে মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্পের ভাষণের লক্ষ্য ছিল একদিকে রিপাবলিকান পেশাদার রাজনীতিকেরা, অন্যদিকে বারাক ওবামা। ‘অভিষেক ভাষণে আমরা ঐক্যের কথা শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু ট্রাম্পের ভাষণ ছিল তার ব্যতিক্রম। এখানে আমরা যা শুনলাম তাকে এক কথায় বলা যায় ট্রাম্পইজম বা ট্রাম্পবাদ।’ একই পত্রিকায় ভাষ্যকার মার্ক ফিশার লিখেছেন, ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঠিক সময়মতো তিনি প্রেসিডেন্টের মতো ব্যবহার করবেন। কিন্তু এই ভাষণ থেকে স্পষ্ট তিনি বিন্দুমাত্র বদলাননি।

ট্রাম্পের ভাষণটি লিখতে সাহায্য করেন ট্রাম্পের প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ ব্যানন। শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী হিসেবে পরিচিত ব্যানন তাঁর বিভাজক রাজনীতির জন্য সুপরিচিত। তিনি বলেছেন, যে ধরনের চাঁছাছোলা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে ট্রাম্প ক্ষমতার শীর্ষে এসেছেন, এই ভাষণটি ছিল তার সঠিক প্রতিফলন। ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি বলেন, আমেরিকার সপ্তম প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জ্যাকসন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ১৮২৯ সালে যে ভাষণ দেন, ট্রাম্পের ভাষণ তার সঙ্গে তুলনীয়। সে ভাষণে জ্যাকসন তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকদের হোয়াইট হাউসের ভেতর এসে উৎসবে যুক্ত হতে আহ্বান করেন। ব্যানন বলেন, সে ভাষণ ছিল গভীরভাবে ‘দেশপ্রেম মূলক।’

অভিষেকের দিন ও তার পরে যে কয়েক লাখ বিক্ষোভকারী মার্কিন রাজধানীতে উপস্থিত হন, তাতে দেশপ্রেমের কোনো উপাদান খুঁজে পেয়েছেন বলে মনে হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *