ষ্টাফ করেসপনডেন্ট
গ্রাম বাংলা নিউজ২৪.কম
ঢাকা: রাজধানীর বস্তিগুলোতে বাস করা ৮০ শতাংশ কন্যাশিশুই বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে বালকদের বাল্যবিবাহের হার অনেক কম, ৪৬ শতাংশ। বেসরকাররি প্রতিষ্ঠানের এক জরিপে ওই তথ্য বেরিয়ে আসছে।
রাজধানীর পাঁচটি বস্তিতে পর্যবেক্ষণ করা দু’টি গবেষণার তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কন্যাশিশুদের এ বাল্যবিবাহের কারণেই মেয়েরা স্বাস্থ্য, মানসিকসহ নানা দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ফলাফল মৃত্যুতে গিয়ে ঠেকতে পারে।
অভিভাবকদের মতে, ভালো পাত্র, দারিদ্র্য ও যৌন হয়রানি এই তিন কারণে মূলত বস্তিগুলোতে বাল্যবিবাহের এ চিত্র তৈরি হয়েছে।
বস্তিতে বাস করা পরিবারগুলো যে ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় এবং এসব পরিবারের উন্নয়নের জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো কী কী কাজ করেছে তা এ গবেষণা দু’টিতে উঠে এসেছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালনায় রাজধানীর কল্যাণপুর পোড়া বস্তি, টাউন হল ক্যাম্প মোহাম্মদপুর, রায়েরবাজার বধ্যভূমি বস্তি, বৌ-বাজার বস্তি ও বালুর মাঠ বস্তি এলাকার শিশুদের ওপর গবেষণা দু’টি পরিচালিত হয়। সেন্টার ফর আরবান স্টাডি এবং দ্য নিয়েলসন গবেষণা দু’টি সম্পাদন করে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশুদের অনুষ্ঠান পরিচালক ড. শাহানা নাজনীন বলেন, বাল্যবিয়ের কারণে অপুষ্টিতে ভুগছে মা ও শিশুরা। অনেক দুর্বল হয়ে শিশুরা জন্মলাভ করছে। বস্তির কন্যাশিশুদের অবস্থা খুবই খারাপ।
নগরায়নের প্রবণতা ও শিশুদের জটিলতা
বস্তিতে বাস করা শিশুদের মধ্য ৪৪ শতাংশ পোশাক কারখানা, ২৪ শতাংশ বিভিন্ন দোকান ও ৯ শতাংশ ভিক্ষাবৃত্তির কাজের সঙ্গে জড়িত। কর্মজীবী শিশুদের মধ্যে ৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার। ১২ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ও বিপজ্জনক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে থাকে।
এছাড়া কর্মজীবী শিশুদের ১১ শতাংশ দৈনিক ১৩ থেকে ১৫ ঘণ্টা, ৪০ শতাংশ ১১ থকে ১২ ঘণ্টা ও ৩২ শতাংশ ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
জন্মসনদ বিষয়ে গবেষকরা জানান, ২০০৪ সাল থেকে বাধ্যতামূলক জন্ম সনদ নেওয়া শুরু হলেও এক্ষেত্রে বস্তির শিশুরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। মাত্র ৩৭ শতাংশ শিশুর জন্ম নিবন্ধন করা হয়। এদের মধ্যে ২৭ শতাংশ বস্তিবাসী টাকা খরচের ভয়ে জন্ম সনদ নেন না।
যেসব শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করা হয় না, ওইসব শিশুদের অভিভাবকদের মধ্যে ৪১ শতাংশ বস্তিবাসী বিষয়টির গুরুত্ব বোঝেন না এবং ৩২ শতাংশ জানেই না কিভাবে নিবন্ধন করতে হয়।
তবে শিক্ষাক্ষেত্রে বস্তির কন্যাশিশুরা বালকদের তুলনায় এগিয়ে আছে। কন্যাশিশুদের ৪৭ শতাংশ বিদ্যালয়ে যায়। এদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ নিয়মিত। আর বালকদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ বিদ্যালয়ে যায়। এদের মধ্যে ৩১ শতাংশ নিয়মিত।
রাজধানীর বস্তির অবস্থানগত বিশ্লেষণ
গবেষণায় বলা হয়েছে, বস্তিতে বসবাসরত মানুষেরা প্রায় সব সময়ই উচ্ছেদ ও অগ্নিকাণ্ডের আতঙ্কে ভুগছেন। এদের মধ্য গত ১০ বছর ধরে ২৫ শতাংশ বস্তিবাসী কয়েকবার উচ্ছেদ হয়েছেন এবং এখনো আতঙ্কে রয়েছেন। একই সময়ে ৪৫ শতাংশ বস্তিবাসী কয়েকবার অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
এ গবেষণায় বস্তির শিশুদের নিয়ে নানা সেবামূলক কার্যক্রমে সরকারের চেয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আছে- এমন তথ্যও উঠে এসেছে।
বস্তি এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হার মাত্র ২২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আর বেসকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হার শতকরা ৭৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।
বস্তির শিশুদের জন্য সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হারও অনেক কম। সরকারি ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে, এনজিও পরিচালিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হার ৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এছাড়া বস্তিবাসীর পানি ও পয়ঃনিস্কাশনে সরকারি কাজের তুলনায় এনজিওগুলো এগিয়ে আছে। সরকার বস্তিবাসীদের জন্য ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ পানি সরবরাহ করে, অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থাগুলোর অবদান ৭৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।
পয়ঃনিস্কাশন প্রণালীতেও সরকারের ভূমিকা ভালো না। এ খাতে সরকারের অবদান মাত্র ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর এনজিওগুলো ৯৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ পয়ঃনিস্কাশন সেবা দেয়।
উপসংহারে গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস ও প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের সুযোগ বৃদ্ধিতে অনেক বেশি উন্নতি হয়েছে। তবুও এসব ক্ষেত্রে এখনও অনেক কিছু করার আছে। শহরের বস্তিতে বসবাসকারী শিশুরা তুলনামূলকভাবে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্নমুখী সেবা থেকে বরাবরই উপেক্ষিত হয়ে আছে।