ঢাকা; জাতীর উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের দাবি ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বলেছে বিএনপি।
আজ শুক্রবার বিকেলে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধানমন্ত্রী তার ভাষনে এমনভাবে চিত্রায়িত করেছেন যে, সব উন্নয়ন তার দুই দফার সরকারের আট বছরে হয়েছে। এটা সঠিক নয়। গত আট বছরে ধনী আরো ধনী, গরীব আরো গরীব হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নয়নের নামে চলছে বল্গাহীন লুণ্ঠন।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ধবংসের মুখে। শেয়ার বাজার লুট, ব্যাংক লুট, দলীয় ব্যক্তিদের ঋণ সুবিধা ও ফেরত না দেবার প্রবণতা বেড়েছে। শুভংকরের ফাঁকি হলো আয় বৈষম্য বেড়েই চলেছে। উন্নয়নের সুফল কিছু সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট ব্যক্তিদের কাছে কুক্ষিগত হচ্ছে। দারিদদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়েছে।
ফখরুল বলেন, আমরা বলতে চাই, অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। ভিত্তি তৈরি করতে হয়, এরপর একটি একটি করে ইট লাগাতে হয়। গণতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক, বৈধ-অবৈধ প্রায় সব সরকারই কমবেশি উন্নয়ন কাজ করেছে। ক্ষুদ্র ঋণ, গ্রামীন অবকাঠামো নির্মাণ, দ্রুত সময়ের মধ্যে দারিদ্রবিমোচন, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট লক্ষ্য অর্জন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, দুর্বল জনগোষ্ঠির জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজগুলো কোনো একটি বিশেষ সরকারের একক প্রচেষ্টার ফসল নয়। প্রধানমন্ত্রীর দাবি তাই অনৈতিক এবং শুধুমাত্র আত্মতুষ্টির প্রচষ্টা।
বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করে বলেন, দেশবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে উন্নয়নের নামে সরকার জনগনকে বিভ্রান্ত করছে। উন্নয়নের নামে চলছে বল্গাহীন লুণ্ঠন।
সরকারের তিন বছর পূর্তিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভাষণের উপর দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতেই এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিলো সাত দশমিক ১১ শতাংশ, আগামী বছর হবে সাত দশমিক চার শতাংশ হবে। এদিকে বিশ্বব্যাংক তাদের গ্লোবাল ইকোনোমিক প্রসপেক্টাস প্রতিবেদনে দাবি করেছে যে, এবছরে প্রবৃদ্ধির হবে ছয় দশমিক আট শতাংশ, আগামী বছর হবে ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ। কারণ যে সব উপাদানের উপর প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে বিশেষ করে বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স সেগুলো নিম্নগামী। বার বার জিডিপি হিসেবের বিভ্রাটে ফেলা হচ্ছে জাতিকে।
তিনি বলেন, বিএনপির আমলে সাত ভাগ অতিক্রম করেছে যে প্রবৃদ্ধি, বর্তমান সরকারের আমলে তা বরং হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জিডিপির হিসেবের যে ইঙ্গিত দিয়েছে, তা সরকারের দাবির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আটশ’ কোটি টাকা লোপাট ঘটনার তদন্ত নিয়ে সরকারের লুকোচুরিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সরকার ড. ফরাসউদ্দিন কমিটির রিপোর্ট নিয়ে লুকোচুরি খেলছে। মনে হচ্ছে, কোনো রাঘব বোয়ালের নাম আড়াল করতেই এই লুকোচুরি। আমরা দাবি করছি, তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হোক, যত ক্ষমতাধরই হোক দায়ি ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হোক, লোপাটকৃত অর্থ ফেরত আনা হোক।
বিএনপি সরকারের আমলে নেয়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে সোলার হোম সিস্টেম প্রকল্প চালু রাখার জন্য সরকারকে স্বাগত জানিয়ে ফখরুল বলেন, দুই লাখ সোলার লাগানোর পরে বেগম খালেদা জিয়া তা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছিলেন। ওই ধারাবাহিকতায় সোলার হোম সিস্টেমের কাজ চলছে যাকে আমরা স্বাগত জানেই। কিন্তু আমরা উদ্বিগ্ন সরকার পাওয়ার প্লান্টের নামে জনগণের পকেট কেটেই চলেছে।
সুন্দরবনের কাছে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন এবং রুপপুরে পারমানবিক প্রকল্প নিয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা ও উদ্বেগের কথাও বলেন ফখরুল। আশ্রয়ন প্রকল্প ও একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প দলীয়করণ, ১০ টাকা কেজি চাল সরবারহের নামে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, শিক্ষাখাতে দুর্নীতি ও শিক্ষারমান নিম্নগামী, সেতু-ব্রিজ-ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় তিন-চারগুন বৃদ্ধির বিষয়গুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, সর্বত্র দুর্নীতি। দেশে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ নেই। সরকারি দলের লোকজনের চাঁদাবাজী, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে বিনিয়োগ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। দেশের পূঁজি পাঁচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। রাজনৈতিক সঙ্কট ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ডেমোক্রেটিক স্পেস ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।
এই সঙ্কট থেকে উত্তরণে একটি নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের দ্বারা সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ, রাজনীতিকে তার স্বাভাবিক চলার পথে চলতে দিতে হবে। তৈরি করতে হবে সবার জন্য সমান সুযোগ। বিরোধী দল নির্মূল করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। উন্নয়নের কথা বলে গণতন্ত্র হত্যা করে, জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা জনগণ কোনো মেনে নেবে না।
ফখরুল বলেন, আমরা এখনো আশা করি, জনগনের আশা-আকাংখা পুরণ করবার জন্য সরকার বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করে আগামী নির্বাচন এবং রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করবেন। নতুন আলোর পথ দেখাবেন।
সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপিকা শাহিদা রফিক, প্রচার সম্পাদক শহিদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, দলের চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান ও শামসুদ্দিন আহমেদ দিদার উপস্থিত ছিলেন।