ঢাকা; সাভারে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী ট্যানারির বর্জ্যে দূষণের শিকার হচ্ছে ধলেশ্বরী নদী। অথচ বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোকে সাভারের পরিকল্পিত চামড়াশিল্প নগরে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ৩৬টি ট্যানারি ইতিমধ্যে সেখানে উৎপাদন শুরু করেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর গত ২৯ ডিসেম্বর ধলেশ্বরী নদীর পানি ও সিইটিপি থেকে বের হওয়া বর্জ্য পরীক্ষা করে ক্ষতিকর ১১টি উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি দেখতে পেয়েছে। এর মধ্যে আছে পানির তাপমাত্রা, ক্ষারের পরিমাণ, দ্রবীভূত অক্সিজেন কম থাকা, বিদ্যুৎ পরিবাহন, ক্রোমিয়ামের পরিমাণ, লবণের পরিমাণ, জৈব রাসায়নিক উপাদান। ধলেশ্বরীর পানি ও সিইটিপি থেকে বের হওয়া বর্জ্য পানি—দুটির নমুনা পরীক্ষা করে এসব উপাদান মানমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে। ফলে শিল্পনগরে নিয়ম না মেনে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) চালুর অভিযোগ তুলেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এটি নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা চীনা প্রতিষ্ঠান জিনসু লিংঝি এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন কোম্পানিকে জরিমানা করা হবে বলে জানিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন, অনেক বছর ধরে ওই চামড়াশিল্প নগর নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দীর্ঘ সময় বেঁধে দিয়ে ট্যানারিগুলোকে সেখানে পর্যায়ক্রমে পাঠানো হচ্ছে। এরপর সেখানে দূষণ হওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর গাফিলতিকে দায়ী করেছেন তাঁরা।
দূষণ ও ক্ষতি
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুযায়ী সিইটিপি থেকে বের হওয়া পানির তাপমাত্রা থাকা উচিত ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সিইটিপির ১০ মিটার উজানে তা ২৩ দশমিক ৫, ৫০০ মিটারের মধ্যে ২৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৩০ মিটার ভাটিতে ২৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পাওয়া গেছে। সিইটিপির তিনটি পয়েন্টে গড়ে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পাওয়া গেছে। পরিবেশবিদেরা বলছেন, পানির তাপমাত্রা বেড়ে গেলে এর প্রাণীকণা ও উদ্ভিদকণা আস্তে আস্তে মরতে শুরু করে। নদীর প্রতিবেশ-ব্যবস্থার প্রাথমিক খাদ্য ওই দুই কণা পানিতে অক্সিজেনও ধরে রাখে।
আর পানিতে ক্ষারের পরিমাণ বেড়ে গেলে মাছসহ অন্য প্রাণীদের দেহে পচন ধরে। এতে মাছের শরীরে প্রাথমিকভাবে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় এবং পর্যায়ক্রমে তারা মারা যেতে পারে। স্বাভাবিক পানিতে ক্ষারের পরিমাণ প্রতি লিটারে থাকার কথা ৬ থেকে ৯ মাত্রায়। ধলেশ্বরীতে পাওয়া গেছে ৮ থেকে ১১ দশমিক ৩৬ মাত্রার।
পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকার কথা সাড়ে ৪ থেকে ৮ মাত্রায়, ধলেশ্বরীতে ইটিপির আশপাশে পাওয়া গেছে শূন্য মাত্রা। সবচেয়ে বিপজ্জনক যে উপাদানটি পাওয়া গেছে তা হচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি। প্রতি লিটারে এই বিষাক্ত উপাদানটি থাকার কথা ২ মাইক্রোগ্রাম। বর্জ্য ফেলার স্থানটিতে তা পাওয়া গেছে ৩২ মাইক্রোগ্রাম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রোমিয়াম পানিতে বেশি থাকলে তা ক্যানসারসহ নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া লবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড) মানমাত্রার কয়েক গুণ বেশি পাওয়া গেছে। আর পানিতে লবণ বেশি থাকলে মাছের মাধ্যমে তা মানবদেহে প্রবেশ করে এবং উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরীক্ষাগার বিভাগের কর্মীদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ধলেশ্বরীতে যেসব রাসায়নিকের মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে তার সব কটিই ট্যানারিতে ব্যবহৃত হয়। এসব দরকারি রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ বাড়তে থাকলে তা ধলেশ্বরী নদীকেও মারাত্মকভাবে দূষিত করে ফেলবে।
কথা শোনেনি চীনা প্রতিষ্ঠান
সিইটিপি কর্তৃপক্ষকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শিল্প এলাকার পানি পরীক্ষা না করে ধলেশ্বরীতে না ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের সেই নির্দেশ পালন করা হয়নি। কোনো পরীক্ষা ছাড়াই ওই দূষিত পানি ও বর্জ্য ধলেশ্বরী নদীতে ফেলেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর বিষয়টি শিল্প মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরে পরীক্ষা না করিয়ে পানি ধলেশ্বরীতে ফেলার বিষয়টি আমরা শিল্প মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। পানি পরীক্ষা করে দূষণের প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টিও তাদের লিখিতভাবে বলেছি। তারা ব্যবস্থা না নিলে আমরা পরিবেশ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।’
পরিবেশদূষণের কারণে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ১৫৪টি ট্যানারি পরিকল্পিত একটি শিল্পনগরীতে নিতে ২০০৩ সালে প্রকল্প নেয় সরকার। সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামে ধলেশ্বরী নদীর পাশে প্রায় ১৯৯ একর জমিতে শুরু হয় চামড়াশিল্প নগরী গড়ে তোলার কাজ। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। মালিকদের গড়িমসি ও সরকারের সিইটিপি নির্মাণের ব্যর্থতার কারণে ১৩ বছরেও ট্যানারিগুলোকে সাভারে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন সরকার সিইটিপি চালানোর উপযোগী করেছে। সেখানে ৩৬টি ট্যানারি উৎপাদন শুরু করেছে। এসব ট্যানারির উৎপাদিত বর্জ্যই সঠিকভাবে পরিশোধন না করে নদীতে ফেলছে চীনা কোম্পানিটি।
সিইটিপি নির্মাণে পরামর্শক দলের প্রধান ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বর্জ্যযুক্ত পানি ফেলার কারণে চীনা কোম্পানিকে জরিমানা করতে তিনি লিখিতভাবে শিল্প মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছেন। জানা গেছে, শিল্প মন্ত্রণালয় চীনা কোম্পানিটিকে তাদের মোট পাওনার ১০ শতাংশ জরিমানা করার চিন্তা করছে, যা ৪০ কোটি টাকার বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১ জানুয়ারি শিল্পসচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চীনা কোম্পানিটির চেয়ারম্যান বাংলাদেশে আসছেন। এ বিষয়ে তাঁর কাছে জবাব চাওয়া হবে। তিনি বলেন, ট্যানারির বর্জ্য কী হারে পরিশোধন করা হবে, তা পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া লবণ পরিশোধনের ব্যবস্থা সিইটিপির বর্তমান অবকাঠামোতেই করা সম্ভব। এ নিয়ে কাজ চলছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, যে চীনা কোম্পানি সিইটিপি স্থাপন করছে তাদের বিরুদ্ধে এর আগেও নিম্নমানের যন্ত্র আমদানির অভিযোগ উঠেছিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তারা যদি যন্ত্র স্থাপন না করে এবং না চালায় তাহলে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে ক্ষতিপূরণ চাওয়া উচিত। দেশের বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করে ওই ট্যানারির দূষণ নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।