ঢাকা; শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ধানের শীষের বিজয় প্রত্যাশা করেছিল বিএনপি। দলটির নেতারা এতদিন ধরে বলে এসেছেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারলে সরকারের প্রতি অনাস্থার প্রতিফলন ঘটবে ফলাফলে। নির্বাচন চলাকালে দলটির তরফে দেয়া তিনদফার ব্রিফিংয়ে সে পরিবেশ নিয়ে সন্তোষও প্রকাশ করা হয়। নির্বাচনে কাঙিক্ষত পরিবেশ বজায় থাকলেও বিপুল ব্যবধানে ফল বিপর্যয় ঘটেছে ধানের বিএনপি প্রার্থীর।
দলটির তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাহ্যিক শান্তির বাতাবরণে শেষ মুহূর্তের সূক্ষ্ম কারচুপি’র অভিযোগ করা হলেও তা পরিষ্কার করা বা মোটাদাগের তথ্য-উপাত্ত হাজির করা হয়নি এখন পর্যন্ত। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মী, নির্বাচনী সমন্বয় ও প্রচারের দায়িত্বপালনকারী এবং একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন তাদের আত্মবিশ্লেষণ ও উপলব্ধির কথা। সেখানে সরকারের তরফে কারচুপির পাশাপাশি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, বিএনপি’র অভ্যন্তরীণ কারণ। নেতাকর্মীরা বলছেন, ভোটের মাঠে অনভিজ্ঞ-অপরিচিত, রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয়, নাসিকের অস্থায়ী বাসিন্দাকে প্রার্থী করে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে বিএনপি। সাংগঠনিকভাবে অগোছালো ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির খেসারত দিতে হয়েছে বিএনপি’র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানকে। স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে যেমন সমন্বয় ছিল না তেমনি তাদের সক্রিয় করতে ব্যর্থ হয়েছে প্রার্থী। প্রচারণা ও গণসংযোগে ছিল ভুল কৌশল। এছাড়া নারায়ণগঞ্জবাসী এ নির্বাচনকে জাতীয় ইস্যুর ভিত্তিতে নয়, নিয়েছেন স্থানীয় নির্বাচন হিসেবেই। সন্ত্রাসকবলিত জনপদ খ্যাত নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের বিপরীতে একজন শক্তিশালী নেতা এবং একটি আশ্রয় হিসেবে সাহসী আইভীকেই বেছে নিয়েছেন তারা। নৌকা বা ধানের শীষ নয়, নাসিক নির্বাচন ছিল আইভী ও সাখাওয়াতের নির্বাচন। নাসিকে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়নি, বিএনপিও হারেনি, হেরেছেন শামীম ওসমান আর জিতেছে শান্তি প্রত্যাশী মানুষ। শেষ বিচারে এ নির্বাচন বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও জনপ্রিয়তার হাওয়া দিয়েছে নৌকার পালে। নেতাকর্মীরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কেন্দ্রীয় অবস্থানের বাইরে মুখ খুলতে নারাজ। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নাসিক নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর প্রধান সমন্বয়ক গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ ফলের পেছনে ‘মিডিয়া ক্যু’ হয়েছে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, দৃশ্যত নির্বাচনটা ফেয়ার, ফলাফলটা আনফেয়ার। এ ফলাফল অপ্রত্যাশিত এবং বিশ্বাসযোগ্য নয়। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই। আমার কথাটা হলো, ভোটের ফলাফলের যে ব্যবধানটা, এটা অত্যন্ত অবিশ্বাস্য। তবে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল বলেন, নাসিক নির্বাচনে ভয়-শঙ্কা-আস্থাহীনতা-শুভঙ্করের ফাঁকির প্রতিফলন ঘটেছে। সামপ্রতিক স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে মানুষ নিজেদের ভোট দিতে পারেনি, প্রতিবাদ করে অনেকে প্রশাসনের রোষানলে পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থাহীনতার কারণে ভোটাররা মনে করেছে ভোট দিয়ে কি হবে ফলাফল তো সরকার যা চায় তাই হবে। এ জন্য সাধারণ ভোটারদের বড় একটি অংশ ভোট দিতেই আসেনি। এছাড়া বিকাল ৩টা পর্যন্ত যেখানে মাত্র ৩০ ভাগ ভোট কাস্ট হয়েছে সেখানে শেষ এক ঘণ্টায় কি করে ৩৩ ভাগ ভোট কাস্ট হলো? এ শুভঙ্করের ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে নাসিক নির্বাচনে।
বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে কারচুপি ও শুভঙ্করের ফাঁকিকে প্রধান করে দেখলে অব দ্য রেকর্ডে প্রকাশ করেছেন বিপর্যয়ের নেপথ্যের নানা কথা। নাসিক নির্বাচনে ধানের শীষের পক্ষে প্রচারণা টিমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এক নেতা জানান, সন্ত্রাসকবলিত এলাকা হিসেবে পরিচিতি রয়েছে নারায়ণগঞ্জের। সেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটি ফ্যাক্টর ওসমান পরিবার। নাসিকবাসী সবসময় এ পরিবারের আতঙ্কে ভুগেন। সন্ত্রাসকবলিত নারায়ণগঞ্জবাসী শান্তি চায়, তারা মনে করেছে সাখাওয়াত সেটা দিতে পারবেন না। তিনি শামীম ওসমানের বিকল্প হতে পারবেন না। নারায়ণগঞ্জবাসী শামীম ওসমানের বিপরীতে একজন শক্তিশালী ব্যক্তিকে নির্বাচিত করতে চেয়েছে আর সে ব্যক্তি হিসেবে তারা আস্থা রেখেছেন আইভীর ওপর।
বিএনপি’র কয়েকজন নেতা জানান, অতীতে যখন গাজীপুর-রাজশাহী-বরিশাল-খুলনা-সিলেটে নির্বাচন হয়েছে তখন মানুষের সামনে একটি স্বপ্ন ছিল। তারা মনে করেছিল, এ নির্বাচনের রেশ পড়বে জাতীয় নির্বাচনে এবং সরকার পরিবর্তন হবে। কিন্তু নাসিক নির্বাচনে তেমন কোন স্বপ্ন ছিল না ভোটারদের সামনে। নারায়ণগঞ্জবাসী নাসিক নির্বাচনকে দেখেছেন স্থানীয় নির্বাচন হিসেবেই। ভোটারদের কথা ছিল, নাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে না। অন্যান্য সিটি মেয়রদের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনা করে তারা মনে করেছে, বিরোধীদলীয় প্রার্থী জিতলেও তিনি কাজ করতে পারবেন না। তাই তাদের কাছে জাতীয় ইস্যু ও দলীয় প্রতীক খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। নাসিক নির্বাচনে জনপ্রিয়তার বিচারে এগিয়ে ছিলেন নৌকার প্রার্থী। বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা টিমের দায়িত্বপালন করা বেশ কয়েকজন মাঝারি সারির নেতা বিষয়টি স্বীকার করে জানান, সত্যিকার অর্থেই নারায়ণগঞ্জে আইভীর জনপ্রিয়তা তুমুল। তারা আইভীকে তারা শক্তিশালী আশ্রয় মনে করেন। নারী ভোটারদের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন আইভী। প্রচারণার সময়ই তারা বিষয়টি খেয়াল করেছেন। বহু বিএনপি পরিবারের নারী ভোটারদের মধ্যেও তারা দেখেছেন আইভীর প্রতি দুর্বলতা।
নাসিক নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর পরাজয়ের নেপথ্যে বড় কারণ ছিল দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা। এ সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রসঙ্গে কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, সৈন্যবাহিনী সুশৃঙ্খল না থাকলে আপনি যুদ্ধে জিতবেন কিভাবে? নারায়ণগঞ্জ জেলা ও শহরে দীর্ঘদিন ধরে কমিটি পুনর্গঠন না হওয়ায় কর্মীদের মধ্যে চেইন অব কমান্ড নেই। সবাই বিভিন্ন নেতার গ্রুপে কাজ করেন বলে তারাও নিজ নিজ নেতার মতোই গা বাঁচিয়ে চলেছেন। নারায়ণগঞ্জ বিএনপি’র কয়েকজন নেতা এ সমন্বয়হীনতার বিষয়টি ইঙ্গিত করে বলেন, শহরে তৈমূরের ভাই, সিদ্ধিরগঞ্জে গিয়াসউদ্দিনের ছেলে জিতেছেন এবং বন্দরে আবুল কালামের ছেলে অল্পের জন্য হেরেছেন। নাসিকে ১২টি ওয়ার্ডে জিতেছে বিএনপি’র কাউন্সিলর প্রার্থী। ওইসব ওয়ার্ডের কেন্দ্রেও কাঙিক্ষত ভোট পড়েনি ধানের শীষে। নাসিক নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে তৈমূর আলম খন্দকার শহর, গিয়াসউদ্দিন সিদ্ধিরগঞ্জ ও আবুল কালাম বন্দরের সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু এই তিন সমন্বয়কের মধ্যেই আসলে সমন্বয় ছিল না। সাখাওয়াত হোসেন নিজেই তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। ফলে তারাও দায়িত্ব নিয়ে সাখাওয়াতের পক্ষে কাজ করেননি। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ছাত্রদল নেতা নাজমুল হাসান বলেন, ‘একটু খেয়াল করলে দেখবেন, নারায়ণগঞ্জের সকল থানায় বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের কমিটি নাই এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। যে কমিটি আছে, তা প্রায় অস্তিত্বহীন। যার ফলে ওয়ার্ড ভিত্তিক স্থানীয় নেতাদের এ নির্বাচনে খুব একটা সক্রিয় করা যায়নি। দিন শেষে এটাই সত্য- সংগঠন না থাকলে কোন কিছুতেই সফলতা অর্জন সম্ভব না। অথচ আমরা নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য এই সংগঠনটাকে ধীরে ধীরে পঙ্গু করে ফেলছি।’ নেতাকর্মীরা জানান, নাসিক নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকার আগেরবার বঞ্চিত হওয়ায় মনোকষ্টে নিয়ে কাজ করেছেন। সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি শহরের বাইরে হওয়ায় তিনিও বড় ভূমিকা রাখতে পারেননি। মহানগর বিএনপি’র সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম অসুস্থতার জন্য বেশি সক্রিয় হতে পারেননি। ধানের শীষের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে জড়িত কয়েকজন নেতা জানান, আওয়ামী লীগের শতকরা ৯০ ভাগ ভোটই পড়েছে আইভীর বাক্সে। কিন্তু ধানের শীষের বড় একটি অংশেরই ভোট পাননি সাখাওয়াত। কারণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন করেছেন আর বিএনপি নেতাকর্মীরা দুলেছেন ভয়, হতাশা আর আস্থাহীনতার দোলাচলে। অন্যদিকে প্রচার কৌশল, যোগাযোগসহ নানাভাবে নারায়ণগঞ্জের নতুন ভোটারদের বড় অংশটিরই সমর্থন আদায় করেছে আওয়ামী লীগ। ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক বায়েজিদ আরেফিন বলেন, ‘কমিটি সময়মতো না হলে কতটা অনৈক্য আর সাংগঠনিক ক্ষতি হয় তার প্রমাণ তো চোখের সামনেই আছে; অতএব সবকিছুর আগে শক্তিশালী সংগঠন তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই।’
নারায়ণগঞ্জ বিএনপি’র নেতারা জানান, প্রার্থী নির্বাচনে ভুল করেছে দল। কারণ সাখাওয়াত হোসেন বারের নির্বাচন করলেও স্থানীয় নির্বাচনে একেবারের অনভিজ্ঞ। সবচেয়ে বড় বিষয়, ধানের শীষের প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন নারায়ণগঞ্জের আদিবাসিন্দা নন। তিনি মুন্সীগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছেন মাত্র আড়াই দশক ধরে। এখনও তিনি ভাড়া বাড়িতেই থাকেন। ফলে তার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জবাসীর সামাজিক বন্ধন তৈরি হয়নি। তিনি বিএনপি’র রাজনীতি করলেও মাঠের রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামে তার তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। ফলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। স্থানীয় নির্বাচনে যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় নির্বাচনে যে গণভিত্তি প্রয়োজন সেটার অভাবে পিছিয়ে পড়েছেন বিএনপি প্রার্থী। নির্বাচনে সাখাওয়াত হোসেন যে ভোট পেয়েছেন তার বড় অংশটিই ধানের শীষের ভোট। ব্যক্তিগত ক্যারিশমা বা জনপ্রিয়তার জায়গা থেকে তিনি তেমন ভোট যোগ করতে পারেননি।
বিএনপি’র প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগের কৌশল নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন দলটির নেতাকর্মীরা। নারায়ণগঞ্জ বিএনপি’র একাধিক নেতা মনে করেন, বিএনপির প্রচার-প্রচারণা ছিল বাহিরের আবরণ কিন্তু ভিতরটা ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। কেন্দ্রীয় নেতারা যতটা না মেয়র প্রার্থীর গণসংযোগে ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন নিজেদের প্রচারণায়। গণসংযোগের তারা ভোটারদের বাড়িতে যাওয়ার চেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেছেন।
বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে কারচুপি ও শুভঙ্করের ফাঁকিকে প্রধান করে দেখলে অব দ্য রেকর্ডে প্রকাশ করেছেন বিপর্যয়ের নেপথ্যের নানা কথা। নাসিক নির্বাচনে ধানের শীষের পক্ষে প্রচারণা টিমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এক নেতা জানান, সন্ত্রাসকবলিত এলাকা হিসেবে পরিচিতি রয়েছে নারায়ণগঞ্জের। সেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটি ফ্যাক্টর ওসমান পরিবার। নাসিকবাসী সবসময় এ পরিবারের আতঙ্কে ভুগেন। সন্ত্রাসকবলিত নারায়ণগঞ্জবাসী শান্তি চায়, তারা মনে করেছে সাখাওয়াত সেটা দিতে পারবেন না। তিনি শামীম ওসমানের বিকল্প হতে পারবেন না। নারায়ণগঞ্জবাসী শামীম ওসমানের বিপরীতে একজন শক্তিশালী ব্যক্তিকে নির্বাচিত করতে চেয়েছে আর সে ব্যক্তি হিসেবে তারা আস্থা রেখেছেন আইভীর ওপর।
বিএনপি’র কয়েকজন নেতা জানান, অতীতে যখন গাজীপুর-রাজশাহী-বরিশাল-খুলনা-সিলেটে নির্বাচন হয়েছে তখন মানুষের সামনে একটি স্বপ্ন ছিল। তারা মনে করেছিল, এ নির্বাচনের রেশ পড়বে জাতীয় নির্বাচনে এবং সরকার পরিবর্তন হবে। কিন্তু নাসিক নির্বাচনে তেমন কোন স্বপ্ন ছিল না ভোটারদের সামনে। নারায়ণগঞ্জবাসী নাসিক নির্বাচনকে দেখেছেন স্থানীয় নির্বাচন হিসেবেই। ভোটারদের কথা ছিল, নাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে না। অন্যান্য সিটি মেয়রদের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনা করে তারা মনে করেছে, বিরোধীদলীয় প্রার্থী জিতলেও তিনি কাজ করতে পারবেন না। তাই তাদের কাছে জাতীয় ইস্যু ও দলীয় প্রতীক খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। নাসিক নির্বাচনে জনপ্রিয়তার বিচারে এগিয়ে ছিলেন নৌকার প্রার্থী। বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা টিমের দায়িত্বপালন করা বেশ কয়েকজন মাঝারি সারির নেতা বিষয়টি স্বীকার করে জানান, সত্যিকার অর্থেই নারায়ণগঞ্জে আইভীর জনপ্রিয়তা তুমুল। তারা আইভীকে তারা শক্তিশালী আশ্রয় মনে করেন। নারী ভোটারদের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন আইভী। প্রচারণার সময়ই তারা বিষয়টি খেয়াল করেছেন। বহু বিএনপি পরিবারের নারী ভোটারদের মধ্যেও তারা দেখেছেন আইভীর প্রতি দুর্বলতা।
নাসিক নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর পরাজয়ের নেপথ্যে বড় কারণ ছিল দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা। এ সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রসঙ্গে কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, সৈন্যবাহিনী সুশৃঙ্খল না থাকলে আপনি যুদ্ধে জিতবেন কিভাবে? নারায়ণগঞ্জ জেলা ও শহরে দীর্ঘদিন ধরে কমিটি পুনর্গঠন না হওয়ায় কর্মীদের মধ্যে চেইন অব কমান্ড নেই। সবাই বিভিন্ন নেতার গ্রুপে কাজ করেন বলে তারাও নিজ নিজ নেতার মতোই গা বাঁচিয়ে চলেছেন। নারায়ণগঞ্জ বিএনপি’র কয়েকজন নেতা এ সমন্বয়হীনতার বিষয়টি ইঙ্গিত করে বলেন, শহরে তৈমূরের ভাই, সিদ্ধিরগঞ্জে গিয়াসউদ্দিনের ছেলে জিতেছেন এবং বন্দরে আবুল কালামের ছেলে অল্পের জন্য হেরেছেন। নাসিকে ১২টি ওয়ার্ডে জিতেছে বিএনপি’র কাউন্সিলর প্রার্থী। ওইসব ওয়ার্ডের কেন্দ্রেও কাঙিক্ষত ভোট পড়েনি ধানের শীষে। নাসিক নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে তৈমূর আলম খন্দকার শহর, গিয়াসউদ্দিন সিদ্ধিরগঞ্জ ও আবুল কালাম বন্দরের সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু এই তিন সমন্বয়কের মধ্যেই আসলে সমন্বয় ছিল না। সাখাওয়াত হোসেন নিজেই তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। ফলে তারাও দায়িত্ব নিয়ে সাখাওয়াতের পক্ষে কাজ করেননি। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ছাত্রদল নেতা নাজমুল হাসান বলেন, ‘একটু খেয়াল করলে দেখবেন, নারায়ণগঞ্জের সকল থানায় বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের কমিটি নাই এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। যে কমিটি আছে, তা প্রায় অস্তিত্বহীন। যার ফলে ওয়ার্ড ভিত্তিক স্থানীয় নেতাদের এ নির্বাচনে খুব একটা সক্রিয় করা যায়নি। দিন শেষে এটাই সত্য- সংগঠন না থাকলে কোন কিছুতেই সফলতা অর্জন সম্ভব না। অথচ আমরা নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য এই সংগঠনটাকে ধীরে ধীরে পঙ্গু করে ফেলছি।’ নেতাকর্মীরা জানান, নাসিক নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকার আগেরবার বঞ্চিত হওয়ায় মনোকষ্টে নিয়ে কাজ করেছেন। সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি শহরের বাইরে হওয়ায় তিনিও বড় ভূমিকা রাখতে পারেননি। মহানগর বিএনপি’র সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম অসুস্থতার জন্য বেশি সক্রিয় হতে পারেননি। ধানের শীষের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে জড়িত কয়েকজন নেতা জানান, আওয়ামী লীগের শতকরা ৯০ ভাগ ভোটই পড়েছে আইভীর বাক্সে। কিন্তু ধানের শীষের বড় একটি অংশেরই ভোট পাননি সাখাওয়াত। কারণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন করেছেন আর বিএনপি নেতাকর্মীরা দুলেছেন ভয়, হতাশা আর আস্থাহীনতার দোলাচলে। অন্যদিকে প্রচার কৌশল, যোগাযোগসহ নানাভাবে নারায়ণগঞ্জের নতুন ভোটারদের বড় অংশটিরই সমর্থন আদায় করেছে আওয়ামী লীগ। ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক বায়েজিদ আরেফিন বলেন, ‘কমিটি সময়মতো না হলে কতটা অনৈক্য আর সাংগঠনিক ক্ষতি হয় তার প্রমাণ তো চোখের সামনেই আছে; অতএব সবকিছুর আগে শক্তিশালী সংগঠন তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই।’
নারায়ণগঞ্জ বিএনপি’র নেতারা জানান, প্রার্থী নির্বাচনে ভুল করেছে দল। কারণ সাখাওয়াত হোসেন বারের নির্বাচন করলেও স্থানীয় নির্বাচনে একেবারের অনভিজ্ঞ। সবচেয়ে বড় বিষয়, ধানের শীষের প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন নারায়ণগঞ্জের আদিবাসিন্দা নন। তিনি মুন্সীগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছেন মাত্র আড়াই দশক ধরে। এখনও তিনি ভাড়া বাড়িতেই থাকেন। ফলে তার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জবাসীর সামাজিক বন্ধন তৈরি হয়নি। তিনি বিএনপি’র রাজনীতি করলেও মাঠের রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামে তার তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। ফলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। স্থানীয় নির্বাচনে যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় নির্বাচনে যে গণভিত্তি প্রয়োজন সেটার অভাবে পিছিয়ে পড়েছেন বিএনপি প্রার্থী। নির্বাচনে সাখাওয়াত হোসেন যে ভোট পেয়েছেন তার বড় অংশটিই ধানের শীষের ভোট। ব্যক্তিগত ক্যারিশমা বা জনপ্রিয়তার জায়গা থেকে তিনি তেমন ভোট যোগ করতে পারেননি।
বিএনপি’র প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগের কৌশল নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন দলটির নেতাকর্মীরা। নারায়ণগঞ্জ বিএনপি’র একাধিক নেতা মনে করেন, বিএনপির প্রচার-প্রচারণা ছিল বাহিরের আবরণ কিন্তু ভিতরটা ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। কেন্দ্রীয় নেতারা যতটা না মেয়র প্রার্থীর গণসংযোগে ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন নিজেদের প্রচারণায়। গণসংযোগের তারা ভোটারদের বাড়িতে যাওয়ার চেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেছেন।