স্ত্রী মাহমুদা খানম হত্যার ‘পরিকল্পনাকারী’ নিখোঁজ কামরুল শিকদার ওরফে মুছা এবং কারাগারে থাকা এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা তাঁর ‘সোর্স’ হিসেবে কাজ করতেন বলে জানান বাবুল আক্তার। তদন্ত কর্মকর্তার এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কী কারণে এবং কার নির্দেশে তাঁরা (সোর্স) মাহমুদাকে খুন করেছেন, তা তাঁর জানা নেই। তিনি স্ত্রী হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চান। বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বাবুল আক্তার বারবার মামলার এজাহারে ঘটনার উল্লেখ রয়েছে বলে জানান। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
চট্টগ্রাম নগরের লালদীঘি এলাকায় নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কার্যালয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান। তিনি এখন চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার।
গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায় বাবুল আক্তার একটি সাদা কারে (গাড়ি) করে ডিবি কার্যালয়ে যান। গাড়ি থেকে নেমে তিনি সরাসরি কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় তদন্ত কর্মকর্তার কক্ষে ঢোকেন। তখনই ভেতর থেকে কক্ষের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে কক্ষে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তার পাশের কক্ষেই একসময় বসতেন বাবুল আক্তার।
তদন্ত কর্মকর্তা একাই বাবুল আক্তারকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গেই বাবুল আক্তার ওই কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। দ্রুত দোতলা থেকে নিচে নেমে ওই গাড়িতে ওঠেন। গাড়িতে ওঠার সময় এই প্রতিবেদক কী জিজ্ঞাসা করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
এর আগে গত ২৪ জুন মধ্যরাতে ঢাকার বনশ্রী এলাকার শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবুল আক্তারকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রায় ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে আবার বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। পরে পুলিশ জানায়, বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেছেন তিনি। অবশ্য পরে বাবুল আক্তার বলেন, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি। পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য ৯ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে আবেদন করেন তিনি। ৬ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, ‘বাবুলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হলো।’
গত ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড় এলাকায় মাহমুদা খানমকে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় বাবুল আক্তার অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করেন। অস্ত্র-গুলিসহ অনেক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেন। এ কারণে প্রতিহিংসাবশত জঙ্গিরা তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করতে পারে।
গত জুন মাসেই পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ থেকে ঢাকার পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দেন বাবুল আক্তার। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) ছিলেন।
বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান গতকাল দুপুরে তাঁর কার্যালয়ে বলেন, মামলা-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানতে বাদীকে সপ্তাহ খানেক আগে আসতে বলা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টায় তিনি (বাবুল আক্তার) আসেন। এই মামলায় গ্রেপ্তার ও পলাতক আসামিদের সম্পর্কে তাঁর কাছে কোনো তথ্য আছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে বাবুল আক্তার কিছু জানা নেই বলে জানান। তিনি অঝোরে কেঁদেছেন। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও স্ত্রী মাহমুদার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ ছিল না বলে জানান।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, নিখোঁজ মুছা সম্পর্কে বাবুল আক্তারের কাছে কোন তথ্য আছে, সে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে বাবুল আক্তার বলেন, একসময় মুছা ও ভোলা তাঁর সোর্স ছিলেন। তাঁর দাবি, মুছা কখনো তাঁর বাসায় যাননি। তাঁরা কেন তাঁর স্ত্রীকে খুন করলেন তা তিনি বুঝতে পারছেন না। কী কারণে কার নির্দেশে তাঁরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, তা জানা নেই বলেন তিনি।
মাহমুদা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া দুই আসামি ওয়াসিম ও আনোয়ার ২৬ জুন আদালতে জবানবন্দি দেন। তাঁরা বলেন, মুছার নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। কিন্তু মুছা কার নির্দেশে ও কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি তাঁদের জবানবন্দিতে। এদিকে ২২ জুন চট্টগ্রামের বন্দর এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে পুলিশ মুছাকে ধরে নিয়ে গেছে বলে দাবি করে আসছেন তাঁর স্ত্রী পান্না আক্তার। যদিও এটি অস্বীকার করে মুছাকে ধরিয়ে দিতে ৫ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ।
এদিকে ‘নিখোঁজ’ মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ২০১৩ সাল থেকে তাঁর স্বামী বাবুল আক্তারের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। ফোনে প্রায়ই মুছার সঙ্গে বাবুল আক্তারের কথা হতো বলে দাবি করেন তিনি। তবে কখনো তাঁর বাসায় বাবুল আক্তার আসেননি। তাঁর জানামতে, মুছাও কখনো বাবুল আক্তারের বাসায় যাননি।
ওয়াসিম ও আনোয়ার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন, হত্যাকাণ্ডে তাঁদের (ওয়াসিম ও আনোয়ার) সঙ্গে মো. রাশেদ, নবী, মো. শাহজাহান, কামরুল শিকদার ওরফে মুছা ও মো. কালু অংশ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে নবী ও রাশেদ ৪ জুলাই রাতে রাঙ্গুনিয়ায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলে ছিলেন ওয়াসিম, মুছা ও নবী। মাহমুদাকে ছুরিকাঘাত করেন নবী। অস্ত্র সরবরাহ করেন ভোলা।
হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র-গুলিসহ ২৬ জুন নগরের বাকলিয়া এলাকা থেকে ভোলা ও তাঁর সহযোগী মনির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই ঘটনায় বাকলিয়া থানায় করা পৃথক অস্ত্র মামলায় ২৮ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। কিন্তু ভোলা অস্ত্রগুলো কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন ও কার নির্দেশে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন, তা তদন্তে বের হয়নি।