আলোচনায় সব দলের মেয়র প্রার্থীসহ অন্য বক্তারা বলেন, জাতীয় রাজনীতিতে বৈরিতা থাকলেও নারায়ণগঞ্জে দলীয় প্রতীকের এই নির্বাচনে এখন পর্যন্ত একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। তাঁরা মনে করেন, নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাসের জন্য পরিচিত গডফাদাররা যদি কোনো কারসাজি না করে, শেষ পর্যন্ত এই পরিবেশ বজায় থাকবে। এ জন্য বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। সব প্রার্থীই বলেছেন, তাঁরা একপেশে ও কারচুপির নির্বাচন চান না। সে জন্য সবার বক্তব্যে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সদিচ্ছার কথা এসেছে।
আলোচনা সভায় মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী, বিএনপির মো. সাখাওয়াত হোসেন খান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মাহবুবুর রহমান ইসমাইল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি মাসুম বিল্লাহ, কাউন্সিলর প্রার্থী অসিত বরন বিশ্বাস, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী পপি রানী সরকার, বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক, সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের জেলা শাখার সভাপতি আবদুর রহমান, সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বী, নারী নেত্রী লক্ষ্মী চক্রবর্তী, মুক্তিযোদ্ধা ও মানবাধিকারকর্মী ফরিদা আকতার, নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি মাহবুবুর রহমান মাসুম, নারায়ণগঞ্জ জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুস সালাম ও মানবাধিকার সংগঠক আহসানুল করিম চৌধুরী। জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন বক্তব্য দেন। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান।
সেনা চান সাখাওয়াত, প্রয়োজনে আইভী সব বাহিনীর পক্ষে: বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা মোতায়েন করা হোক, যাতে ভোটাররা আশ্বস্ত হতে পারেন যে তাঁরা নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন। তিনি আইভীর সমালোচনা করে বলেন, গত নির্বাচনে আইভী সেনা মোতায়েনের দাবি করেছিলেন, কিন্তু এবার তিনি সেনা মোতায়েন হোক, তা চাচ্ছেন না।
জবাবে আইভী বলেন, ২০১১ সালের নির্বাচনে যে পরিবেশ ছিল, এখনকার তুলনায় সেটা অনেক বেশি শঙ্কার ছিল। সেই শঙ্কা উপেক্ষা করে মানুষ ভোট দিয়েছে, সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। তিনি সাখাওয়াতের উদ্দেশে বলেন, ‘এখন তো অনেক ভালো পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীর কোনো বাহিনী নেই। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে বড় বাহিনী ছিল। আমার শঙ্কা আপনার চেয়ে বেশি। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে একটি পক্ষ কাজ করছে। আমি বলেছি, ভোট সুষ্ঠু করার জন্য নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনীসহ অন্য যেকোনো বাহিনী প্রয়োজন মনে করলে মোতায়েন করুক। আমি একটা ভালো নির্বাচন চাই।’
মেয়র পদপ্রার্থী মাহবুবুর রহমান ইসমাইল বলেন, ভোটের দিন গডফদাররা ডানা মেলতে পারে। নিজ নিজ দলের উচিত হবে এদের নিয়ন্ত্রণ করা। না হলে বিপদ আছে। তিনি বলেন, ‘বারুদের স্তূপে নির্বাচন করছি, যেকোনো সময় অচিন্তনীয় ঘটনা ঘটতে পারে।’ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা বলেছেন আরেক মেয়র প্রার্থী মুফতি মাসুম বিল্লাহও।
বেশি শঙ্কা কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে: সব প্রার্থী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা শেষ পর্যন্ত ভোট সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়েও নিজেদের আশঙ্কার কথা বলেন। এ ক্ষেত্রে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে যাঁরা বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার আসামি, তাঁদের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি এসেছে। এঁদের মধ্য থেকে নতুন কোনো নূর হোসেনের সৃষ্টি হয় কি না, সেই শঙ্কার কথাও বলেছেন একজন বক্তা।
ব্যবসায়ী নেতা ফজলুল হক বলেন, ভোটের দিন কাউন্সিলর প্রার্থীরা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু তাঁদের বিষয়ে কেউ নজর দিচ্ছে না। সন্ত্রাসী প্রার্থীদের দিকে নজর রাখতে হবে।
জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুস সালাম বলেন, কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ৩৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস ও মাদক মামলা আছে। অনেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। তাঁদের কারণে ভোটের দিন পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। একই শঙ্কার কথা বলেছেন মানবাধিকার সংগঠক আহসানুল করিম।
নাগরিক কমিটির রফিউর রাব্বি বলেন, প্রশাসন নিরপেক্ষ আচরণ করছে না। স্থানীয় পত্রিকায় এসেছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি বলেছেন যে ‘ওই প্রার্থী কীভাবে জেতে দেখব।’ তিনি বলেন, ভোটের আগে পরিবেশ ভালো থাকে, ভোটের দিন পরিবর্তন হয়।
কাউন্সিলর প্রার্থী অসিত বরণ অভিযোগ করেন, এই ভোটে টাকা ও ধর্মের অপব্যবহার হচ্ছে। নারী কাউন্সিলর প্রার্থী পপি রানীও অভিযোগ করেন, নির্বাচনে টাকার খেলা চলছে। তাঁর কাছে এক ভোটার সরাসরি টাকা চেয়েছেন। অনেকে তাঁকে ও তাঁর কর্মীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
মেয়র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন সবার জন্য সমান সুযোগের দাবি করে বলেন, সরকারদলীয়দের প্রভাব বিস্তার করতে দেখা গেছে। পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
আইভী সরকারি দলের প্রভাব সম্পর্কে বলেন, তিনি কোনো সরকারি সুবিধা নেন না। তারপরও তাঁর নাম ভাঙিয়ে কেউ প্রভাব সৃষ্টি করলে, কোনো অঘটন ঘটালে তাকে ধরে পুলিশে দেওয়ার আহ্বান জানান।
কমিশনের প্রতি অসন্তোষ: আলোচনায় প্রায় সবাই নির্বাচন কমিশনের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা কমিশনকে শক্ত অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান।
সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কেমন নির্বাচন চায়। সরকার না চাইলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।
আইভী সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসিকে শক্ত অবস্থান নেওয়ার দাবি জানান।
মাহবুবুর রহমান ইসমাইল বলেন, নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ। তাদের আশ্বাসে আস্থা রাখা কঠিন।
রফিউর রাব্বি বলেন, সরকার না চাইলে ভালো নির্বাচন হবে না। দেখতে হবে সরকার কী চায়। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন স্থানীয় সরকারের চরিত্র হারিয়েছে। এখন নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হয়ে গেছে। এটা উন্নয়নের পথে বড় বাধা।
রাব্বি বলেন, পাঁচ বছর আগে নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কা ছিল তা থেকে এখনো বের হওয়া যায়নি। এ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত মানুষরূপী প্রাণীগুলো এখনো এখানে বসবাস করছে। কূটকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে প্রশাসনকে নজর দিতে হবে।
ফজলুল হক বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত আস্থা তৈরি করতে পারেনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাদের কোনো পরিকল্পনা দেখি না।’
মুফতি মাসুম বিল্লাহ নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, প্রতিটি নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া হয়। এবার তা করা হয়নি। কোনো অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও কোনো সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়নি।
আবদুস সালাম বলেন, নির্বাচন কমিশনের ভ্রাম্যমাণ দলগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না। কমিশনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ১০৬টি অভিযোগ জমা পড়লেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তারা এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্র জমা নেওয়ার কাজও হয়নি।
পপি রানী বলেন, নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত এমন কিছু করেনি, যাতে মনে হবে যে ভালো নির্বাচন হবে।
সাখাওয়াতকে মিষ্টি খাওয়াবেন আইভী: আইভী বলেন, ‘সাখাওয়াত ভাইকে আশ্বস্ত করে বলছি, উনি যদি নির্বাচিত হন আমি সবার আগে গিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানাব, মিষ্টি খাওয়াব। আশা করি, আমি জিতলে তিনিও আমাকে অভিনন্দন জানাবেন এবং মিষ্টি খেয়ে যাবেন।’
সাখাওয়াত হোসেন বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির কথা বললেও আইভী বলেছেন, তাঁর কোনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নেই। তিনি তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে চান। কারণ, পাঁচ বছরে কোনো কাজ ভালোভাবে শেষ করা যায় না।
প্রত্যাশা: নারী নেত্রী লক্ষ্মী চক্রবর্তী বলেন, ‘সবার কাছে প্রত্যাশা থাকবে, নারায়ণগঞ্জ যেন বসবাসের উপযোগী হয়। গডফাদারের ভূমিকায় কাউকে দেখতে চাই না’।
নাগরিক কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক বলেন, ‘ভোট সুষ্ঠু হবে, নারায়ণগঞ্জ থেকে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবে, এটা প্রত্যাশা করি।’
প্রার্থীদের সঙ্গে কমিশনের মতবিনিময় সভা আজ: নিজস্ব প্রতিবেদক জানান,নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আজ বৃহস্পতিবার প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবে নির্বাচন কমিশন। সকাল সাড়ে দশটায় নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে এই সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রার্থী এবং করপোরেশনের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।