ডেস্ক রিপোর্ট; নিখোঁজের তালিকায় এবার যুক্ত হয়েছেন পাবনা মেডিকেল কলেজের দুই ছাত্র। তাঁদের একজন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া বরিশালের আগৈলঝাড়ার মাদ্রাসায় পড়ুয়া এক কিশোরও নিখোঁজ রয়েছে। প্রাথমিক তদন্তের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রাথমিক ধারণা, তাঁরা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছেড়েছেন। তাঁদের অবস্থানের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
পাবনা মেডিকেল কলেজের নিখোঁজ দুই ছাত্র হলেন জাকির হোসেন (২২) ও তানভির আহমেদ ওরফে তনয় (২১)। তাঁদের মধ্যে জাকির পাবনা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁদের নিখোঁজের বিষয়ে পাবনা ও রংপুরের কাউনিয়া থানায় জিডি করেছেন তাঁদের অভিভাবকেরা।
মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জাকির ও তানভির পরস্পর বন্ধু বলে জানিয়েছেন তাঁর অন্য বন্ধু ও সহপাঠীরা। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা একসঙ্গেই নিখোঁজ হয়েছেন।
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরের জামিয়াতুল নাফিজিয়া আল ইসলামিয়া মার্কাস মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নিখোঁজের ঘটনায় আগৈলঝাড়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। ওই কিশোর নিখোঁজ হওয়ার পাঁচ দিন পর তার মায়ের ফোনে ক্ষমা চেয়ে তার নামে একটি খুদে বার্তা এসেছে। তবে পরিবার ও পুলিশ বলছে, এটি উড়ো বার্তা।
চলতি সপ্তাহে এ পর্যন্ত নয়জন তরুণ-কিশোর নিখোঁজ হওয়ার খবর জানা গেল। এর মধ্যে ১ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থেকে একসঙ্গে চার তরুণ নিখোঁজ হন। তাঁদের মধ্যে দুজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ও একজন বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র। এর আগে ২৯ নভেম্বর সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি রাজধানীর কেয়ার মেডিকেল কলেজের এক ছাত্র। সর্বশেষ ৫ ডিসেম্বর সকালে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি সদ্য ও লেভেল পাস করা এক তরুণ।
এর আগে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত কয়েক দফায় ঢাকার বেশ কয়েকজন তরুণ নিখোঁজ হয়েছিলেন। এই তরুণদের কয়েকজন পরে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোঁরায় ও শোলাকিয়ায় ঈদগাহে হামলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে দেখা যায়। কয়েকজন পরে পুলিশ-র্যাবের অভিযানে নিহত হন। গত আগস্টে ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছিল, ৪০ থেকে ৫০ জন তরুণ নিখোঁজ রয়েছেন। একই সময়ে র্যাব প্রথমে ২৬২ জন নিখোঁজের তালিকা প্রকাশ করলেও পরে তা ৬৮-তে নেমে আসে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, ‘ফ্রেশ তরুণদের (পূর্বে অপরাধে যুক্ত নন এমন) বিদেশে পাঠানো সহজ। তাদের দিয়ে অনেক কিছুই করানো সম্ভব। এরা কোথায় যাচ্ছে, কারা এদের নিয়ে যাচ্ছে—এসব খুঁজে বের করতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।’
পাবনা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা জাকির হোসেনের বাবা রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সুরুজ্জামান স্থানীয় থানায় ৪ ডিসেম্বর একটি জিডি করেন। সেই জিডিতে উল্লেখ করা হয়, ১ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে লালমনিরহাট এক্সপ্রেস ট্রেন ধরতে কাউনিয়ার বাড়ি থেকে লালমনিরহাটের উদ্দেশে বের হয়েছিলেন জাকির। ওই ট্রেনে করে তাঁর পাবনায় যাওয়ার কথা ছিল। বিকেল পর্যন্ত বাবার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়েছে জাকিরের।
জাকিরের বাবা মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ্জামান বলেন, ১ ডিসেম্বর বিকেলে জাকিরের সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ কথা হয়। তখন জাকির জানিয়েছিলেন, তিনি ট্রেনে গাইবান্ধার বোনারপাড়া এলাকা পার হচ্ছেন। এরপর তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাকির পাবনা মেডিকেলে যাননি। বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে। কোথাও তাঁর সন্ধান না পেয়ে ৪ ডিসেম্বর তিনি কাউনিয়া থানায় জিডি করেন।
কাউনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মামুন উর রশিদ বলেন, জিডির তদন্ত চলছে। পুলিশও ছেলেটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো হদিস মেলেনি।
জাকিরের সঙ্গে নিখোঁজ আরেক মেডিকেল ছাত্র তানভিরের বাড়ি রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ায়। তাঁর বাবা দিনাজপুরে মৃত্তিকা সম্পদ অফিসের হিসাবরক্ষক নূর আলম সরকার বলেন, ৩০ নভেম্বর পাবনা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে তানভিরের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জানায়। ওই রাতেই পাবনায় ছুটে যান তিনি, কিন্তু ছেলের কোনো খোঁজ পাননি। উদ্বিগ্ন এই পিতা আবেগী হয়ে বলেন, ‘আমার দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে ছেলেটি বড়। ছোট বোনের মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন ৬ অক্টোবর সে সর্বশেষ বাড়িতে এসেছিল। দুই দিন পরেই আবার পাবনায় চলে যায়। এখন সারা দেশেই তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু কোনো সন্ধান পাচ্ছি না।’
পাবনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ রিয়াজুল হকবলেন, নিখোঁজ দুজনেই চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে ছাত্রাবাসে থাকতেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে তানভির গত ৩০ নভেম্বর ক্যাম্পাস থেকে নিখোঁজ হন। এ ঘটনার রাতেই পাবনার সদর থানায় একটি জিডি করা হয়। অন্য একজন শিক্ষার্থী যেহেতু ক্যাম্পাসে ছিলেন না। বাড়ি থেকে পাবনায় আসার পথে নিখোঁজ হন, এ কারণে তাঁর পরিবার সেখানে জিডি করেছেন। দুজনেরই বাবা ও স্বজনেরা পাবনায় এসেছিলেন। তাঁদের সন্ধান পেতে চেষ্টা চলছে।
পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তানভিরের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি জিডি করেছে। তিনি জানান, নিখোঁজ দুই শিক্ষার্থীর কারও বিরুদ্ধেই তাঁর থানায় এর আগে কোনো অভিযোগ আসেনি।
নিখোঁজদের অন্য বন্ধুরা বলছেন, জাকির ও তানভির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে জাকির ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর তাঁর বন্ধু তানভির ক্যাম্পাসে তাবলিগ করতেন। তবে তানভির তাবলিগ করতেন কি না, এ বিষয়ে পরিবার কোনো তথ্য জানাতে পারেনি।
পাবনা মেডিকেল কলেজের সদ্য বিদায়ী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবু তোরাব বলেন, ‘জাকির হোসেন ছাত্রলীগ মেডিকেল কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর সন্ধানের জন্য আমরাও অনেক চেষ্টা করছি।’ তানভিরের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।
কিশোর নিখোঁজ
বরিশালের আগৈলঝাড়ার জামিয়াতুল নাফিজিয়া মাদ্রাসার ১৬ বছর বয়সী এক ছাত্র ছয় দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছে বলে গত রোববার রাতে থানায় একটি জিডি করা হয়।
জিডিতে বলা হয়েছে, ১০ দিন ছুটি শেষে গত ২৭ নভেম্বর মাদ্রাসায় ফিরে আসে ছেলেটি। গত ৩০ নভেম্বর জোহরের নামাজ পড়েই সে মাদ্রাসা থেকে নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের পর আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর তার বাবা খোরশেদ ব্যাপারী আগৈলঝাড়া থানায় জিডি করেন।
ছেলেটির মা কোহিনূর বেগম বলেন, ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পরে তাঁকে অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বরিশালে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কার্যালয়ে খুঁজতে। তিনি তা-ই করেছেন, কিন্তু ছেলেকে পাননি। আগৈলঝাড়া থানার পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায়ও ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।
কোহিনূর বলেন, নিখোঁজ হওয়ার পর গত মঙ্গলবার তাঁর ফোনে একটি খুদে বার্তা আসে। তাতে লেখা রয়েছে, ‘মা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি যেথায় থাকি না কেন চিন্তা করবে না।’ বার্তাটির শেষে তাঁর ছেলের নাম লেখা। তবে এটি তাঁর ছেলের নম্বর থেকে নয়, অন্য নম্বর থেকে এসেছে। তাঁরা বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছেন।