ঢাকা; জনতার রায় ছিল তাদের পক্ষে। বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন তারা। কিন্তু নগরভবনের মেয়রের মসনদে থিতু হতে পারেননি কেউই। উল্টো মেয়র পদ তাদের জন্য নিয়ে এসেছে বিপর্যয়। একের পর এক মামলা। এক মামলায় জামিন। নতুন মামলায় গ্রেপ্তার। ফের কারাগার। কারাগারই যেন তাদের ঠিকানা। সাময়িক বরখাস্ত। বরখাস্তের আদেশ স্থগিত। নতুন মামলায় চার্জশিট। ফের বরখাস্ত। ভাগ্য বদলায় না। ভাগ্যবিড়ম্বিত এমন নগরপিতাদের কয়েকজনকে নিয়ে লিখেছেন, আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি চৌধুরী মুমতাজ আহমদ, স্টাফ রিপোর্টার মো. আমির হোসেন, রাশিদুল ইসলাম, ইকবাল আহমদ সরকার, আসলাম-উদ-দৌলা
ছন্দময় জীবনে ছন্দপতন: পরিবর্তনের সুর তুলে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। তার ম্যাজিকে উড়ে যান স্থানীয় আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতা বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। সিটি করপোরেশনের প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই নগরের অভিভাবকের দায়িত্বে থাকা কামরান বিশাল ব্যবধানে হার মানেন আরিফুল হকের কাছে। সব হিসেব নিকেশ উল্টে দিয়ে আরিফুল হক চৌধুরীই হন সিলেটের মেয়র। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর উন্নয়ন কাজ দিয়ে চমকে দিতে থাকেন নগরবাসীকে। একদম বিপরীত আদর্শের দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মনও জয় করে নেন আরিফুল হক। নগরের উন্নয়ন কাজ পরিদর্শনে অর্থমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় করে ঘুরতে দেখা যায় আরিফুল হককে।
হঠাৎই ছন্দপতন ঘটে আরিফুল হকের ছন্দময় জীবনে। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে সামনে উঠে আসে আরিফুল হকের নাম। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিনিয়র এএসপি মেহেরুন্নেছা পারুল তৃতীয় দফা সম্পূরক চার্জশিটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র গোলাম কিবরিয়া (জি কে) গউছসহ নতুন আরো ১০ জনের সঙ্গে অভিযুক্ত হিসেবে আরিফুল হক চৌধুরীকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। ২০১৪ সালের ১৩ই নভেম্বর তিনি আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। তবে ঐ চার্জশিটে ত্রুটি থাকায় ৩রা ডিসেম্বর তা সংশোধনের জন্য আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। সংশোধন শেষে ২১শে ডিসেম্বর মেহেরুন্নেছা পারুল আবার আদালতে চার্জশিট জমা দেন। হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রশীদ আহমেদ মিলন সে চার্জশিট গ্রহণ করে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। ৩০শে ডিসেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আরিফুল হক চৌধুরী। আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। শুরু হয় আরিফুল হকের কারাবন্দি জীবন। আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ায় ২০১৫ সালের ৭ই জানুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে কারাবন্দি আরিফুল হককে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায়ই কিবরিয়া হত্যা সংশ্লিষ্ট বিস্ফোরক মামলায়ও আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন আরিফুল হক চৌধুরী। ২০১৫ সালের ১২শে মে আরিফুল হক ও জি কে গউছসহ কারাগারে বন্দি থাকা অভিযুক্তদের বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেছা পারুল। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে ১লা জুন আদালত তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ দেন। ১০ই আগস্ট এ মামলায় হবিগঞ্জের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ আদালতে সম্পূরক চার্জশিট জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। ৫ই জানুয়ারি আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ আতাবুল্লাহ চার্জশিট গ্রহণ করেন।
১৫ মাস বন্দি জীবন কাটানোর পর মাঝে ১৫ দিন মুক্তির দেখা পেয়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। আরিফুল হকের নিজের এবং তার মায়ের অসুস্থতা বিবেচনায় নিয়ে ২০১৬ সালের ২২শে মার্চ বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী মোহাম্মদ ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ কিবরিয়া হত্যা মামলায় ১৫ দিনের জামিন মঞ্জুর করেন। ২৭শে মার্চ বিস্ফোরক মামলায় হবিগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতও ১৫ দিনের জামিন দেন আরিফুল হককে। জামিন আদেশ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছুলে ২৮শে মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায়ই মুক্ত হন আরিফুল হক। জামিনের মেয়াদ শেষে ১১ই এপ্রিল সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হাজির হন আরিফুল হক। আদালতের বিচারক মকবুল আহসান তার জামিন নামঞ্জুর করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
কিবরিয়া হত্যা মামলায় কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় নতুন আরো একটি মামলায় নাম আসে আরিফুল হকের। আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলায় সিলেট সিটি করপোরেশনের বরখাস্ত হওয়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও হবিগঞ্জ পৌরসভার বরখাস্ত হওয়া মেয়র জিকে গৌছকে এ মামলায় সংযুক্ত করতে চান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি হবিগঞ্জ জোনের সহকারী পুলিশ সুপার বসু দত্ত চাকমা। ২০শে জুলাই সুনামগঞ্জের (দিরাই) আমলগ্রহণকারী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে কারাবন্দি এ দুই মেয়রকে গ্রেনেড হামলা মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আবেদন করেন তিনি। আবেদনটি শুনানির অপেক্ষায় থাকে।
এরই মাঝে আরিফুল হকের বিরুদ্ধে থাকা দুটো মামলার মধ্যে কিবরিয়া হত্যা ঘটনায় দায়ের হওয়া মূল মামলায় গত ৬ই সেপ্টেম্বর আরিফুল হক চৌধুরীকে জামিন প্রদান করেন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। পরে জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ৮ই সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ সে আবেদন নাকচ করে দেন। অপরদিকে ১৩ই নভেম্বর বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আরিফুল হক চৌধুরীকে হত্যা সংশ্লিষ্ট বিস্ফোরক মামলায়ও জামিন দেন। রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন পরদিনই খারিজ করে দেন চেম্বার জজ সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তবে দুটো মামলায় জামিন পেলেও দিরাইয়ের গ্রেনেড হামলা মামলায় হাজিরা থাকায় মুক্ত হতে পারেননি আরিফুল হক চৌধুরী। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ২৭ নভেম্বর সুনামগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয় জি কে গউছ ও আরিফুল হককে। সুনামগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সালেহ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় বোমা হামলা মামলায় সম্পূরক চার্জশিট গ্রহণ করে আরিফুল হক ও জি কে গউছকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন। আরিফুল হক চৌধুরী এখন সে মামলাতেই কারাবন্দি আছেন।
মামলার জালে আটকে আছেন মান্ন্নান: সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্য- এ দুইয়ের রেকর্ড গড়ার কপাল সাবেক প্রতিমন্ত্রী, বহিষ্কৃত সিটি মেয়র ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এম এ মান্নানের। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন সংসদ সদস্য, আবার লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের তিনবারের পৌর মেয়রকে হারিয়ে প্রথম সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড গড়েছিলেন। আবার এই জেলায় শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বেশিসংখ্যক মামলার আসামি হয়ে আর টানা বেশি দিন জেলে থেকে রেকর্ড করেছেন। মামলায় জামিন হবার সঙ্গে সঙ্গেই আবারো ফেঁসে যাচ্ছেন নতুন মামলার জালে। এম এ মান্নান বর্তমানে গাজীপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এ বন্দি রয়েছেন। ইতিমধ্যেই দুটি নাশকতার মামলায় এমএ মান্নানের নামে চার্জশিট দাখিল হয়েছে। প্রথমে গতবছর আগস্ট মাসে তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি আদালতের নির্দেশে মেয়র পদ ফিরে পেলেও গত এপ্রিল মাসে ফের তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এম এ মান্নানকে তার ডিওএইচএস এর বাসা থেকে গত বছরের ১১ই ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়। একে একে ২৮টি মামলায় কারান্তরীণ হয়ে আছেন। সবশেষ অধ্যাপক এম এ মান্নানকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন আপিল বিভাগ বহাল রাখার দিনই ২০১৪ সালের ঘটনায় গত ২৪শে নভেম্বর রাতে চাঁদাবাজির এ মামলা করা হয়। কারাগারে বন্দি অধ্যাপক এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে সর্বশেষ জয়দেবপুর থানায় মামলা করা হয়েছে। মান্নানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিদ্দিকুর রহমান জানান, সর্বশেষ ২৩শে নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভের পর এবং মোট ২৭টি মামলায় জামিন পেয়ে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা অধ্যাপক এম এ মান্নানকে চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলে তার মুক্তি শেষবারের মতো আটকে যায়। এর আগে গত ২৪শে নভেম্বর মেয়র মান্নানকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
আশা পরিণত হলো হতাশায়: সহসাই কি মুক্ত হয়ে পথ চলতে পারবেন জি কে গউছ? নাকি নতুন কোনো মামলার জটে আটকে পড়ছেন, এমন নানা আলোচনা হবিগঞ্জ পৌরবাসীর মধ্যে। ২০১৫ সালের ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে কারারুদ্ধ জি কে গউছকেই তাদের অভিভাবক বানিয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখছিলেন, তাদের রায়ের সম্মান পাবে, কারামুক্ত হয়ে ফিরে আসবেন তাদের নির্বাচিত অভিভাবক। আবারও প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে আসবে পৌর শহরে। আয়োজন হবে গণবিয়ের। উন্নয়নের বার্তা নিয়ে দাপিয়ে ঘুরে বেড়াবেন শহরের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত। ব্যতিক্রমী নানা কার্যক্রম দিয়ে শহরবাসীকে মাতিয়ে রাখবেন। কিন্তু পৌরবাসীর সেই স্বপ্নের ফুল ফুটেনি। মামলার জটে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি জনতার রায়ে নির্বাচিত মেয়র জি কে গউছ। সেই থেকে আবারও থমকে যায় পৌরবাসী।
গত ২৪শে নভেম্বর সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান জি কে গউছ। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে আবারও উজ্জীবিত হয়ে উঠেন পৌরবাসী। কিন্তু পৌরবাসীর এই অপেক্ষার প্রহর এখনো শেষ হয়নি। হত্যা মামলায় জামিন হলেও একই ঘটনায় দায়েরকৃত বিস্ফোরক মামলায় জামিন হয়নি। অপরদিকে ২০০৪ সালের ২১শে জুন সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় বোমা হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত বিস্ফোরক মামলায় জি কে গউছকে শ্যোন এরেস্ট দেখানো হয়েছে। প্রায় ১২ বছর পর ২০১৬ সালের ২০শে জুলাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি’র হবিগঞ্জ জোনের সহকারী পুলিশ সুপার বসু দত্ত চাকমা আদালতে আবেদন করেন জি কে গউছকে শ্যোন এরেস্ট দেখাতে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৭শে নভেম্বর সুনামগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সালেহ জি কে গউছকে শ্যোন এরেস্ট দেখান এবং তার জামিন নামঞ্জুর করেন। তাই কারামুক্ত হতে হলে জি কে গউছকে আরো ২টি মামলায় জামিন লাভ করতে হবে। ২০১৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর থেকে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় কারাগারে আছেন জি কে গউছ তবুও নগর ভবনে ফিরতে পারেননি বুলবুল: রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিশাল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। মেয়রদের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা না দেয়ায় শুরুতেই প্রতিবাদ করেন রাসিক মেয়র। সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ গাড়ি না নিয়ে পায়ে হেঁটে কখনো মোটরসাইকেল যোগে অফিস করেছেন। তবে বিগত ৫ই জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তার ওপর খড়গ নেমে আসে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিএনপি জোটের অবরোধ-হরতাল চলাকালে ৯টি মামলাসহ মেয়র বুলবুলের নামে মোট ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪টিতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ হত্যা মামলাও রয়েছে। সিদ্ধার্থ হত্যা মামলা মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন মেয়র। দু’বারে কারাগারে থেকেছেন প্রায় ৭ মাস। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় (৭ই মে) সাময়িক বরখাস্ত হন। মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল মানবজমিনকে বলেন, ‘৬ মাস আগেই সাময়িক বরখাস্তের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশটি অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। পরে আপিল বিভাগেও তা বহাল থাকে। এরপরও পূর্ণাঙ্গ আদেশ প্রকাশিত না হওয়ার অজুহাত দেখায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গত মাসের ২৪ তারিখ সে পূর্ণাঙ্গ আদেশও প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ১লা নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অদ্যাবধি কোনো উত্তর দিচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে একের পর এক মামলায় জড়ানো হয়েছে। দু’বারে ৭ মাস জেল খেটেছি। হাইকোর্টে প্রতিকার চেয়েছিলাম। এখন আবার জনগণের জন্য কাজ করার সুযোগ এসেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের জন্য কাজ করার কোনো সুযোগ দেয়ার মনোভাব তৈরি হয়নি। অহেতুক বিলম্ব সৃষ্টি করে রাজশাহীর নগরবাসীর প্রতি অন্যায় করে আসছে।
কারাগার আর কোর্টেই সময় পার মনিরের: খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান মনির নির্বাচিত হয়েও দায়িত্ব পালন করতে পারেননি বেশি দিন। হামলা-মামলা, জেল খেটে, সাময়িক বরখাস্ত হয়ে সময় কেটেছে অনেক দিন। মেয়রের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় হামলায় রক্তাক্ত হতে হয়েছে একাধিক বার। তার বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা ও নাশকতার অভিযোগে মামলা রয়েছে তিনটি। সকল চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দীর্ঘ এক বছর দশদিন পর সর্বোচ্চ আদালতে আইনি লড়াইয়ে বিজয়ের পর গত ২১শে নভেম্বর চেয়ারে বসেন তিনি। এর মধ্যে আবার কারাগারে কেটেছে ২৫ দিন। সব মিলিয়ে লড়াই সংগ্রাম করতে করতেই পার হয়ে যাচ্ছে মেয়রের পাঁচ বছর।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৫ই জুন অনুষ্ঠিত কেসিসি নির্বাচনে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি ৬০ হাজার ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। বেশ বিড়ম্বনার পর ওই বছরের ২৫শে সেপ্টেম্বর তিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৩ সালের ২৬শে নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খুলনা মহানগরীর পাওয়ার হাউজ মোড়ে বিএনপির কর্মসূচি চলাকালে সংঘর্ষে আহত হন। ঐদিন রাতে পুলিশের ওপর হামলা ও নাশকতার অভিযোগে সদর থানায় সিটি মেয়রসহ ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ২৫০ জনের নামে মামলা করেছিল পুলিশ। ২০১৫ সালের ৩০শে এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ৫২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২২শে নভেম্বর আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার পর পলাতক ১৬ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। ফলে ২০১৫ সালের ২রা নভেম্বর স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। ২০১৫ সালের ১৬ই মার্চ পলাতক থাকায় বরখাস্তকৃত মেয়র মনিরুজ্জামান মনি, দু’জন কাউন্সিলরসহ ৬ জনের অস্থাবর সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ দেন মুখ্য মহানগর হাকিম এমএলবি মেছবাহ উদ্দিন আহমেদ।
আইনজীবীদের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিএনপির আন্দোলনকালে নাশকতার দুটি মামলায় তিনি গত বছর ২৩শে মার্চ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। মহানগর দায়রা জজ আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে হাজতে প্রেরণ করেন। দুটি মামলায় গত ১৩ই এপ্রিল হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিনলাভ করেন। সাময়িক বরখাস্তের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে মেয়র মনি রিট পিটিশন (যার নং-৭০৭৯/১৬) দায়ের করলে আদালত চলতি বছরের ৭ই জুন সরকারি আদেশকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে রুল ইস্যু করে ও স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। গত ১০ই আগস্ট হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখে আপিল বিভাগ। দীর্ঘ এক বছর ১০ দিন পর সর্বোচ্চ আদালতে আইনি লড়াইয়ে বিজয়ের পর গত ২১ই নভেম্বরে চেয়ারে বসেন মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি।
মনিরুজ্জামান মনি বলেন, আমার লড়াই-সংগ্রাম শুরু হয়েছে ছাত্র জীবন থেকেই। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলা আমার আজন্ম অভ্যাস। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে সরাসরি যুদ্ধ করেছি। মাথা নত করার অভ্যাস আমার নেই। রাজনৈতিক জীবনেও বারবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। জেল-জুলুম ভয়ের কিছুই নেই। খুলনাবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে আমি নির্বাচিত মেয়র। জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকারের উচিত আমাকে নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা। জনগণকে নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত করলে জনগণ একদিন তার জবাব দেবে। দৃঢ়চেতা মনিরুজ্জামান মনি বলেন সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে বিগত দিনে জনগণের পাশে ছিলাম ইনশাআল্লাহ আগামীতেও থাকবো।
ছন্দময় জীবনে ছন্দপতন: পরিবর্তনের সুর তুলে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। তার ম্যাজিকে উড়ে যান স্থানীয় আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতা বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। সিটি করপোরেশনের প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই নগরের অভিভাবকের দায়িত্বে থাকা কামরান বিশাল ব্যবধানে হার মানেন আরিফুল হকের কাছে। সব হিসেব নিকেশ উল্টে দিয়ে আরিফুল হক চৌধুরীই হন সিলেটের মেয়র। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর উন্নয়ন কাজ দিয়ে চমকে দিতে থাকেন নগরবাসীকে। একদম বিপরীত আদর্শের দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মনও জয় করে নেন আরিফুল হক। নগরের উন্নয়ন কাজ পরিদর্শনে অর্থমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় করে ঘুরতে দেখা যায় আরিফুল হককে।
হঠাৎই ছন্দপতন ঘটে আরিফুল হকের ছন্দময় জীবনে। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে সামনে উঠে আসে আরিফুল হকের নাম। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিনিয়র এএসপি মেহেরুন্নেছা পারুল তৃতীয় দফা সম্পূরক চার্জশিটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র গোলাম কিবরিয়া (জি কে) গউছসহ নতুন আরো ১০ জনের সঙ্গে অভিযুক্ত হিসেবে আরিফুল হক চৌধুরীকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। ২০১৪ সালের ১৩ই নভেম্বর তিনি আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। তবে ঐ চার্জশিটে ত্রুটি থাকায় ৩রা ডিসেম্বর তা সংশোধনের জন্য আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। সংশোধন শেষে ২১শে ডিসেম্বর মেহেরুন্নেছা পারুল আবার আদালতে চার্জশিট জমা দেন। হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রশীদ আহমেদ মিলন সে চার্জশিট গ্রহণ করে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। ৩০শে ডিসেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আরিফুল হক চৌধুরী। আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। শুরু হয় আরিফুল হকের কারাবন্দি জীবন। আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ায় ২০১৫ সালের ৭ই জানুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে কারাবন্দি আরিফুল হককে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায়ই কিবরিয়া হত্যা সংশ্লিষ্ট বিস্ফোরক মামলায়ও আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন আরিফুল হক চৌধুরী। ২০১৫ সালের ১২শে মে আরিফুল হক ও জি কে গউছসহ কারাগারে বন্দি থাকা অভিযুক্তদের বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেছা পারুল। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে ১লা জুন আদালত তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ দেন। ১০ই আগস্ট এ মামলায় হবিগঞ্জের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ আদালতে সম্পূরক চার্জশিট জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। ৫ই জানুয়ারি আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ আতাবুল্লাহ চার্জশিট গ্রহণ করেন।
১৫ মাস বন্দি জীবন কাটানোর পর মাঝে ১৫ দিন মুক্তির দেখা পেয়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। আরিফুল হকের নিজের এবং তার মায়ের অসুস্থতা বিবেচনায় নিয়ে ২০১৬ সালের ২২শে মার্চ বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী মোহাম্মদ ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ কিবরিয়া হত্যা মামলায় ১৫ দিনের জামিন মঞ্জুর করেন। ২৭শে মার্চ বিস্ফোরক মামলায় হবিগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতও ১৫ দিনের জামিন দেন আরিফুল হককে। জামিন আদেশ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছুলে ২৮শে মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায়ই মুক্ত হন আরিফুল হক। জামিনের মেয়াদ শেষে ১১ই এপ্রিল সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হাজির হন আরিফুল হক। আদালতের বিচারক মকবুল আহসান তার জামিন নামঞ্জুর করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
কিবরিয়া হত্যা মামলায় কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় নতুন আরো একটি মামলায় নাম আসে আরিফুল হকের। আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলায় সিলেট সিটি করপোরেশনের বরখাস্ত হওয়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও হবিগঞ্জ পৌরসভার বরখাস্ত হওয়া মেয়র জিকে গৌছকে এ মামলায় সংযুক্ত করতে চান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি হবিগঞ্জ জোনের সহকারী পুলিশ সুপার বসু দত্ত চাকমা। ২০শে জুলাই সুনামগঞ্জের (দিরাই) আমলগ্রহণকারী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে কারাবন্দি এ দুই মেয়রকে গ্রেনেড হামলা মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আবেদন করেন তিনি। আবেদনটি শুনানির অপেক্ষায় থাকে।
এরই মাঝে আরিফুল হকের বিরুদ্ধে থাকা দুটো মামলার মধ্যে কিবরিয়া হত্যা ঘটনায় দায়ের হওয়া মূল মামলায় গত ৬ই সেপ্টেম্বর আরিফুল হক চৌধুরীকে জামিন প্রদান করেন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। পরে জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ৮ই সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ সে আবেদন নাকচ করে দেন। অপরদিকে ১৩ই নভেম্বর বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আরিফুল হক চৌধুরীকে হত্যা সংশ্লিষ্ট বিস্ফোরক মামলায়ও জামিন দেন। রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন পরদিনই খারিজ করে দেন চেম্বার জজ সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তবে দুটো মামলায় জামিন পেলেও দিরাইয়ের গ্রেনেড হামলা মামলায় হাজিরা থাকায় মুক্ত হতে পারেননি আরিফুল হক চৌধুরী। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ২৭ নভেম্বর সুনামগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয় জি কে গউছ ও আরিফুল হককে। সুনামগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সালেহ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় বোমা হামলা মামলায় সম্পূরক চার্জশিট গ্রহণ করে আরিফুল হক ও জি কে গউছকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন। আরিফুল হক চৌধুরী এখন সে মামলাতেই কারাবন্দি আছেন।
মামলার জালে আটকে আছেন মান্ন্নান: সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্য- এ দুইয়ের রেকর্ড গড়ার কপাল সাবেক প্রতিমন্ত্রী, বহিষ্কৃত সিটি মেয়র ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এম এ মান্নানের। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন সংসদ সদস্য, আবার লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের তিনবারের পৌর মেয়রকে হারিয়ে প্রথম সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড গড়েছিলেন। আবার এই জেলায় শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বেশিসংখ্যক মামলার আসামি হয়ে আর টানা বেশি দিন জেলে থেকে রেকর্ড করেছেন। মামলায় জামিন হবার সঙ্গে সঙ্গেই আবারো ফেঁসে যাচ্ছেন নতুন মামলার জালে। এম এ মান্নান বর্তমানে গাজীপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এ বন্দি রয়েছেন। ইতিমধ্যেই দুটি নাশকতার মামলায় এমএ মান্নানের নামে চার্জশিট দাখিল হয়েছে। প্রথমে গতবছর আগস্ট মাসে তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি আদালতের নির্দেশে মেয়র পদ ফিরে পেলেও গত এপ্রিল মাসে ফের তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এম এ মান্নানকে তার ডিওএইচএস এর বাসা থেকে গত বছরের ১১ই ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়। একে একে ২৮টি মামলায় কারান্তরীণ হয়ে আছেন। সবশেষ অধ্যাপক এম এ মান্নানকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন আপিল বিভাগ বহাল রাখার দিনই ২০১৪ সালের ঘটনায় গত ২৪শে নভেম্বর রাতে চাঁদাবাজির এ মামলা করা হয়। কারাগারে বন্দি অধ্যাপক এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে সর্বশেষ জয়দেবপুর থানায় মামলা করা হয়েছে। মান্নানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিদ্দিকুর রহমান জানান, সর্বশেষ ২৩শে নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভের পর এবং মোট ২৭টি মামলায় জামিন পেয়ে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা অধ্যাপক এম এ মান্নানকে চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলে তার মুক্তি শেষবারের মতো আটকে যায়। এর আগে গত ২৪শে নভেম্বর মেয়র মান্নানকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
আশা পরিণত হলো হতাশায়: সহসাই কি মুক্ত হয়ে পথ চলতে পারবেন জি কে গউছ? নাকি নতুন কোনো মামলার জটে আটকে পড়ছেন, এমন নানা আলোচনা হবিগঞ্জ পৌরবাসীর মধ্যে। ২০১৫ সালের ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে কারারুদ্ধ জি কে গউছকেই তাদের অভিভাবক বানিয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখছিলেন, তাদের রায়ের সম্মান পাবে, কারামুক্ত হয়ে ফিরে আসবেন তাদের নির্বাচিত অভিভাবক। আবারও প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে আসবে পৌর শহরে। আয়োজন হবে গণবিয়ের। উন্নয়নের বার্তা নিয়ে দাপিয়ে ঘুরে বেড়াবেন শহরের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত। ব্যতিক্রমী নানা কার্যক্রম দিয়ে শহরবাসীকে মাতিয়ে রাখবেন। কিন্তু পৌরবাসীর সেই স্বপ্নের ফুল ফুটেনি। মামলার জটে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি জনতার রায়ে নির্বাচিত মেয়র জি কে গউছ। সেই থেকে আবারও থমকে যায় পৌরবাসী।
গত ২৪শে নভেম্বর সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান জি কে গউছ। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে আবারও উজ্জীবিত হয়ে উঠেন পৌরবাসী। কিন্তু পৌরবাসীর এই অপেক্ষার প্রহর এখনো শেষ হয়নি। হত্যা মামলায় জামিন হলেও একই ঘটনায় দায়েরকৃত বিস্ফোরক মামলায় জামিন হয়নি। অপরদিকে ২০০৪ সালের ২১শে জুন সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় বোমা হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত বিস্ফোরক মামলায় জি কে গউছকে শ্যোন এরেস্ট দেখানো হয়েছে। প্রায় ১২ বছর পর ২০১৬ সালের ২০শে জুলাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি’র হবিগঞ্জ জোনের সহকারী পুলিশ সুপার বসু দত্ত চাকমা আদালতে আবেদন করেন জি কে গউছকে শ্যোন এরেস্ট দেখাতে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৭শে নভেম্বর সুনামগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সালেহ জি কে গউছকে শ্যোন এরেস্ট দেখান এবং তার জামিন নামঞ্জুর করেন। তাই কারামুক্ত হতে হলে জি কে গউছকে আরো ২টি মামলায় জামিন লাভ করতে হবে। ২০১৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর থেকে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় কারাগারে আছেন জি কে গউছ তবুও নগর ভবনে ফিরতে পারেননি বুলবুল: রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিশাল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। মেয়রদের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা না দেয়ায় শুরুতেই প্রতিবাদ করেন রাসিক মেয়র। সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ গাড়ি না নিয়ে পায়ে হেঁটে কখনো মোটরসাইকেল যোগে অফিস করেছেন। তবে বিগত ৫ই জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তার ওপর খড়গ নেমে আসে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিএনপি জোটের অবরোধ-হরতাল চলাকালে ৯টি মামলাসহ মেয়র বুলবুলের নামে মোট ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪টিতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ হত্যা মামলাও রয়েছে। সিদ্ধার্থ হত্যা মামলা মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন মেয়র। দু’বারে কারাগারে থেকেছেন প্রায় ৭ মাস। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় (৭ই মে) সাময়িক বরখাস্ত হন। মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল মানবজমিনকে বলেন, ‘৬ মাস আগেই সাময়িক বরখাস্তের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশটি অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। পরে আপিল বিভাগেও তা বহাল থাকে। এরপরও পূর্ণাঙ্গ আদেশ প্রকাশিত না হওয়ার অজুহাত দেখায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গত মাসের ২৪ তারিখ সে পূর্ণাঙ্গ আদেশও প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ১লা নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অদ্যাবধি কোনো উত্তর দিচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে একের পর এক মামলায় জড়ানো হয়েছে। দু’বারে ৭ মাস জেল খেটেছি। হাইকোর্টে প্রতিকার চেয়েছিলাম। এখন আবার জনগণের জন্য কাজ করার সুযোগ এসেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের জন্য কাজ করার কোনো সুযোগ দেয়ার মনোভাব তৈরি হয়নি। অহেতুক বিলম্ব সৃষ্টি করে রাজশাহীর নগরবাসীর প্রতি অন্যায় করে আসছে।
কারাগার আর কোর্টেই সময় পার মনিরের: খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান মনির নির্বাচিত হয়েও দায়িত্ব পালন করতে পারেননি বেশি দিন। হামলা-মামলা, জেল খেটে, সাময়িক বরখাস্ত হয়ে সময় কেটেছে অনেক দিন। মেয়রের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় হামলায় রক্তাক্ত হতে হয়েছে একাধিক বার। তার বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা ও নাশকতার অভিযোগে মামলা রয়েছে তিনটি। সকল চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দীর্ঘ এক বছর দশদিন পর সর্বোচ্চ আদালতে আইনি লড়াইয়ে বিজয়ের পর গত ২১শে নভেম্বর চেয়ারে বসেন তিনি। এর মধ্যে আবার কারাগারে কেটেছে ২৫ দিন। সব মিলিয়ে লড়াই সংগ্রাম করতে করতেই পার হয়ে যাচ্ছে মেয়রের পাঁচ বছর।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৫ই জুন অনুষ্ঠিত কেসিসি নির্বাচনে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি ৬০ হাজার ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। বেশ বিড়ম্বনার পর ওই বছরের ২৫শে সেপ্টেম্বর তিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৩ সালের ২৬শে নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খুলনা মহানগরীর পাওয়ার হাউজ মোড়ে বিএনপির কর্মসূচি চলাকালে সংঘর্ষে আহত হন। ঐদিন রাতে পুলিশের ওপর হামলা ও নাশকতার অভিযোগে সদর থানায় সিটি মেয়রসহ ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ২৫০ জনের নামে মামলা করেছিল পুলিশ। ২০১৫ সালের ৩০শে এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ৫২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২২শে নভেম্বর আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার পর পলাতক ১৬ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। ফলে ২০১৫ সালের ২রা নভেম্বর স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। ২০১৫ সালের ১৬ই মার্চ পলাতক থাকায় বরখাস্তকৃত মেয়র মনিরুজ্জামান মনি, দু’জন কাউন্সিলরসহ ৬ জনের অস্থাবর সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ দেন মুখ্য মহানগর হাকিম এমএলবি মেছবাহ উদ্দিন আহমেদ।
আইনজীবীদের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিএনপির আন্দোলনকালে নাশকতার দুটি মামলায় তিনি গত বছর ২৩শে মার্চ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। মহানগর দায়রা জজ আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে হাজতে প্রেরণ করেন। দুটি মামলায় গত ১৩ই এপ্রিল হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিনলাভ করেন। সাময়িক বরখাস্তের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে মেয়র মনি রিট পিটিশন (যার নং-৭০৭৯/১৬) দায়ের করলে আদালত চলতি বছরের ৭ই জুন সরকারি আদেশকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে রুল ইস্যু করে ও স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। গত ১০ই আগস্ট হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখে আপিল বিভাগ। দীর্ঘ এক বছর ১০ দিন পর সর্বোচ্চ আদালতে আইনি লড়াইয়ে বিজয়ের পর গত ২১ই নভেম্বরে চেয়ারে বসেন মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি।
মনিরুজ্জামান মনি বলেন, আমার লড়াই-সংগ্রাম শুরু হয়েছে ছাত্র জীবন থেকেই। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলা আমার আজন্ম অভ্যাস। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে সরাসরি যুদ্ধ করেছি। মাথা নত করার অভ্যাস আমার নেই। রাজনৈতিক জীবনেও বারবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। জেল-জুলুম ভয়ের কিছুই নেই। খুলনাবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে আমি নির্বাচিত মেয়র। জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকারের উচিত আমাকে নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা। জনগণকে নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত করলে জনগণ একদিন তার জবাব দেবে। দৃঢ়চেতা মনিরুজ্জামান মনি বলেন সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে বিগত দিনে জনগণের পাশে ছিলাম ইনশাআল্লাহ আগামীতেও থাকবো।