নারায়ণগঞ্জ; শহরের কেন্দ্রস্থলে নারায়ণগঞ্জ ক্লাব কমিউনিটি সেন্টার। এখানে প্রতিদিন বিয়েসহ নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান-উৎসব হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সারা দিন সেখানে ছিল অন্য রকম এক উৎসবের আমেজ। সেখানে স্থাপিত রিটার্নিং কর্মকর্তার অস্থায়ী কার্যালয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ আটটি রাজনৈতিক দলের আটজন ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সদ্য বিদায়ী মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ছাড়া অন্যরা প্রথমবারের মতো এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
এটি দলীয় প্রতীকে প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। ২০১১ সালে এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এক লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী শামীম ওসমানকে পরাজিত করেন। তবে এবার আইভীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান। তিনি জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি। নারায়ণগঞ্জে র্যাবের হাতে সাত খুনের ঘটনার প্রতিবাদ-আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে তিনি বিশেষ পরিচিতি পান। প্রতিদ্বন্দ্বী এই প্রার্থীকে মোটেও দুর্বল ভাবছেন না আইভী। সাখাওয়াত হোসেন খানও বলছেন, তিনি আইভীর চেয়ে কোনো অংশে কম নন।
মেয়র পদে অন্য প্রার্থীরা হলেন জাসদের (ইনু) মোসলেম উদ্দিন আহম্মেদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মাহবুবুর রহমান (ইসমাইল), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) কামাল প্রধান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাসুম বিল্লাহ ও ইসলামী ঐক্যজোট বাংলাদেশের ইজহারুল হক। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন সুলতান মাহমুদ।
নৌকা আমাকে আরও এগিয়ে নেবে: গতকাল বেলা ১১টা ২০ মিনিটে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক আবদুল হাই, সাবেক সাংসদ আবদুল্লাহ আল কায়সার, সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক ও নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যবসায়ী আবদুর রাশেদ ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমিনুর রহমান।
মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী সাংবাদিকদের বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মানুষ আইভীকে যেভাবে চেনে সেভাবেই চিনবে, এবার একটু বেশি চিনবে। কারণ নৌকা। নৌকা সবার পছন্দ।’
গত নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েনের দাবি করেছিলেন, এবারও কি সেই দাবি জানাবেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আইভী বলেন, ‘আমি একদম প্রথম দিকে সেনা মোতায়েনের কথা বলেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে আপনারাই দেখেছেন, আমি বলেছিলাম নারায়ণগঞ্জের লক্ষ জনতাই আমার সেনাবাহিনী। গতবার সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে সেনাবাহিনী ছাড়াই।’ তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর কোনো প্রয়োজন নেই।
প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থীর বিষয়ে আইভী বলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যে-ই হোক না কেন, অবশ্যই ওই প্রার্থী শক্তিশালী। নির্বাচনে ওই প্রার্থীকে দুর্বল ভাবার কোনো কারণ নেই। লড়েই আমি জয়ী হতে চাই। আমি অতীতে কোনো আচরণবিধি লঙ্ঘন করিনি এবং নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করব না।’ তিনি আশা করেন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে নির্বাচন কমিশন সব পদক্ষেপ নেবে।
সমতা চাইলেন বিএনপির প্রার্থী: গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকার ও সাধারণ সম্পাদক কাজী মনিরুজ্জামান, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল এবং সাবেক সাংসদ আবুল কালাম ও গিয়াস উদ্দিন।
মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের মানুষের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি দাবি করেন, সবার জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) তৈরি হয়নি। সব প্রার্থীকে একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যতটুকু যোগ্য, আমিও তার চেয়ে কম নই। সাত খুনসহ নানা ঘটনায় আমি নারায়ণগঞ্জবাসীর পাশে ছিলাম। নারায়ণগঞ্জের মানুষ জেগে উঠেছে। নারায়ণগঞ্জের মানুষ পরিবর্তন চায়। পরিবর্তনের আশা নিয়ে এবং ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সবাই আগামী ২২ ডিসেম্বর তাঁদের রায় দেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছেন।’
নজরুলের স্ত্রীও আছেন মাঠে: নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় নিহত ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম এবারও একই ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন।
সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদলও এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদপ্রার্থী। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শাহজালাল আচরণবিধি লঙ্ঘন করে অর্ধশতাধিক সমর্থক নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে রিটার্নিং কর্মকর্তা বাধা দেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, পাঁচজনের বেশি থাকা যাবে না। থাকলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর শাহজালালের সমর্থকেরা বেরিয়ে যান।
একইভাবে প্রায় ৩০ জন সমর্থক নিয়ে কাউন্সিলর পদে (১৮ নম্বর ওয়ার্ড) মনোনয়নপত্র জমা দিতে যান শ্রমিক লীগের নেতা কামরুল হাসান।
বিএনপির সাবেক সাংসদ আবুল কালামের ছেলে মহানগর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাউসার ২৩ নম্বর ওয়ার্ড, সাবেক সাংসদ মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের তিন ছেলে জি এম সাদরিল, জি এম কায়সার, জি এম সানভীর ৫ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।
এ ছাড়া জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই মহানগর যুবদলের সভাপতি মাকসুদুল আলম খন্দকার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করব: রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে গতকাল দিনভর নারায়ণগঞ্জ ক্লাব কমিউনিটি সেন্টারসহ আশপাশের এলাকা ছিল সরগরম। সকাল নয়টার পর থেকেই একের পর এক প্রার্থী আসছেন। হাসিমুখে মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে রিটার্নিং কর্মকর্তা ছাড়াও আলাদা নয়জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নয়টি ডেস্কে বসেন। বিকেল পাঁচটায় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ মুহূর্তেও অনেক প্রার্থী এসেছেন মনোনয়নপত্র জমা দিতে। ২১ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া বাকি সব ওয়ার্ডে আগের কাউন্সিলররা এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, মেয়র পদে মোট নয়জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ২৭টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১৭৬ জন এবং সংরক্ষিত নয়টি মহিলা ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ৩৮ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
২৫ ও ২৬ নভেম্বর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হবে। আর প্রত্যাহার করার শেষ তারিখ ৪ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে ৫ ডিসেম্বর।
রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। আমরা সেটা নিশ্চিত করব।’ তিনি বলেন, এই নির্বাচনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত থাকবেন, তাঁরা এখন নির্বাচনী কর্মকর্তা, তাঁদের কঠোরভাবে নির্বাচনের আইন মানতে হবে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য থাকবেন।