এই জীবনে বেশির ভাগ কাজই আমি করেছি ঝোঁকের মাথায়। হঠাৎ একটা ইচ্ছে হলো, কোনো দিকে না তাকিয়ে ইচ্ছাটাকে সম্মান দিলাম। পরে যা হবার হবে। দু-একটা উদাহারণ দিই—আমাদের সময় সায়েন্সের ছেলেদের ইউনিভার্সিটিতে এসে ইংরেজি বা ইকোনমিকস পড়া ছিল ফ্যাশন। আমিও ফ্যাশনমতো ইকোনমিকসে ভর্তি হয়ে গেলাম। এক বন্ধু পড়বে কেমিস্ট্রি। তাকে নিয়ে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে এসেছি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। কেমিস্ট্রির একজন স্যার হঠাৎ বারান্দায় এলেন। তাকে দেখে আমি মুগ্ধ। কী স্মার্ট, কী সুন্দর চেহারা। তিনি কী মনে করে যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করলাম ইকোনমিকস জলে ভেসে যাক। আমি পড়ব কেমিস্ট্রি। ভর্তি হয়ে গেলাম কেমিস্ট্রিতে। ওই স্যারের নাম মাহবুবুল হক। কালিনারায়ণ স্কলার। ভৌত রসায়নের ওস্তাদ লোক। যিনি অঙ্ক করিয়ে করিয়ে পরবর্তী সময়ে আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন।
পিএইচডি করতে গেলাম ভৌত রসায়নে। কোর্স ওয়ার্ক সব শেষ করেছি। দু বছর কেটে গেছে। একদিন বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট টানছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম, তিনশ দশ নাম্বার রুমে বুড়ো এক ভদ্রলোক ক্লাস নিতে ঢুকলেন। রোগা লম্বা একজন মানুষ। গায়ে আলখাল্লার মতো কোট। আমার কী যে খেয়াল হলো কে জানে। আমিও ক্লাসে ঢুকলাম। সমস্ত কোর্স শেষ করেছি, আর কোর্স নিতে হবে না। কাজেই এখন নিশ্চিন্ত মনে একটা ক্লাসে ঢোকা যায়।
বুড়ো ভদ্রলোকের নাম জেনো উইকস। পলিমার রসায়ন বিভাগের প্রধান। আমি তাঁর লেকচার শুনে মুগ্ধ। যেমন পড়ানোর ভঙ্গি তেমনই বিষয়বস্তু। দৈত্যাকৃতি অণুর বিচিত্র জগৎ। ক্লাস শেষে আমি তাকে গিয়ে বললাম, আমি আপনার বিভাগে আসতে চাই।
ভৌত রসায়নের প্রফেসর সব শুনে খুব রাগ করলেন। আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, তুমি যা করতে যাচ্ছ, খুব বড় ধরনের বোকারাও তা করে না। পিএইচডির কাজ তোমার অনেক দূর এগিয়েছে। কোর্স ওয়ার্ক শেষ করেছ এবং খুব ভালোভাবে করেছ। এখন বিভাগ বদলাতে চাও কেন? মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলে দাও।
আমি ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না। ঢুকে গেলাম পলিমার রসায়নে। প্রফেসর জেনো উইকস অনেক করলেন। আমাকে ভালো একটা স্কলারশিপ দিলেন। বইপত্র দিয়ে সাহায্য করলেন। কাজ শুরু করলাম পলিমার রসায়নের আর এক জাঁদরেল ব্যক্তি প্রফেসর গ্লাসের সঙ্গে। পলিমারের সব কোর্স যখন নিয়ে শেষ করেছি তখন প্রফেসর গ্লাস আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে নিয়ে বললেন, মাই ডিয়ার সান, দয়া করে এখন শখের বশে অন্য কোনো ক্লাসে গিয়ে বসবে না। ডিগ্রি শেষ করো। আরেকটা কথা, আমেরিকান সিটিজেনশিপ পাওয়ার ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।
আমি বললাম, আমেরিকান সিটিজেনশিপ দিয়ে আমি কী করব?
‘তুমি চাও না?’
‘না, আমি চাই না। ডিগ্রি শেষ হওয়ামাত্র আমি দেশে ফিরে যাব।’
‘বিদেশী ছাত্ররা শুরুতে সবাই এ রকম বলে। শেষে আর যেতে চায় না।’
‘আমি চাই।’
ডিগ্রি শেষ করে দেশে ফিরলাম। সাত বছর আমেরিকায় কাটিয়ে যে সম্পদ নিয়ে ফিরলাম তা হলো নগদ পঞ্চাশ ডলার, দুই স্যুটকেস ভর্তি বাচ্চাদের পুরানো খেলনা, এক স্যুটকেস বই এবং প্রচুর চকলেট।
আমি যে সব সময় ইমপালসের উপরে চলি তা কিন্তু না। কাজে-কর্মে, চিন্তাভাবনায় আমি শুধু যে গোছানো তা না, অসম্ভব গোছানো। কখন কী করব, কতক্ষণ করব তা আগেভাগে ঠিক করা। কঠিন রুটিন। সময় ভাগ করা, তারপরেও হঠাৎ হঠাৎ কেন জানি মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। উদ্ভট একেকটা কাণ্ড করে বসি। কোনো সুস্থ মাথার মানুষ যা কখনো করবে না। (সংক্ষেপিত)
সূত্র: অনন্ত অম্বরে বই থেকে পুনর্মুদ্রিত