ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ফেসবুক প্রতিনিধিদের একাধিক বৈঠকের পর সোশ্যাল নেটওয়ার্কটির কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে বিভিন্ন রিপোর্টে বা
অনুসন্ধানে দ্রুত উত্তর দিচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ রিপোর্টেই ফেসবুকের পক্ষ থেকে উত্তর আসছে_ তারা সংশ্লিষ্ট স্ট্যাটাসের রিপোর্ট থেকে অভিযুক্তের ব্যাপারে অস্বাভাবিক বা অন্যায় করার কোনো প্রমাণ পাচ্ছে না। কারও কারও মতে, ফেসবুকের ‘সীমাবদ্ধতা’ হচ্ছে, এখানে প্রত্যেক অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য রক্ষার নীতি মেনে চলা হয়। তাই প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কেউ কোনো রিপোর্ট করছে কি-না, তা নিশ্চিত না হয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য দিতে চাইছে না। তাদের মতে, বাংলাদেশের মতো অনেক দেশেরই স্থানীয় ভাষা, শব্দের অর্থ ও প্রয়োগ, স্থানীয় ভাষা কিংবা সংস্কৃতি সম্পর্কে ফেসবুকের নীতিনির্ধারকরা অবগত কিংবা অবহিত নন। তারা নিজস্ব মূল্যায়ন থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের পরিস্থিতি বুঝতে না পারার কারণেই রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফেসবুক ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকার কিংবা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান কারোরই কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে ব্যবহারকারীর অসচেতনতার কারণেই ফেসবুকে তার অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে যাচ্ছে। ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে অসচেতন ব্যবহারকারীদের উত্তেজিত করে তোলা হচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রদায়িক হামলা ও ফেসবুক :ফেসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সৃষ্টির একটি বড় উদাহরণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রতিক ঘটনা। এক ব্যক্তির ফেসবুক টাইমলাইনে ফটোশপের মাধ্যমে বিকৃত করে একটি ছবি পোস্ট করে এ ঘটনা ঘটানো হয়। উগ্র ধর্মান্ধ একদল ব্যক্তি এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তারপর সমাবেশ ঘটিয়ে একযোগে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির এবং বাড়িঘরে হামলা চালায়। এলাকার লোকজন জানান, ওই ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রযুক্তিগত জ্ঞান একেবারেই নেই। ফটোশপ কী, তাও জানা নেই তার। শখের বশে অন্যের দেখাদেখি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলেন তিনি। সেটি তিনি নিয়মিত ব্যবহারও করেন না। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তার এফবি অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে কিংবা পাসওয়ার্ড চুরি অথবা পরিবর্তন করে অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছবি পোস্ট করা হয়। এর আগেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্ররা শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কার্যালয়ে তাণ্ডব চালায় এবং ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে আক্রমণ চালিয়ে তার ব্যবহৃত অমূল্য সম্পদও ভাংচুর করে। কক্সবাজারের রামুতেও একইভাবে ফেসবুকের অপব্যবহার করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। অনেকেরই প্রশ্ন, তা হলে এসব ঘটনার পেছনে কারা? ফেসবুকের ভূমিকাই বা কী?
এ ব্যাপারে অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট এবং গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘এ ঘটনার জন্য মূলত দায়ী সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। দায়ী স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বলতা কিংবা দায়িত্বহীনতা। ফেসবুক একটি মাধ্যম মাত্র, শুধু এই মাধ্যমের ওপর দায় চাপালে প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে থেকেই যাবে এবং উৎসাহিত হবে।’ তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে মৌলবাদী অপরাধীরা অত্যন্ত সংঘবদ্ধ। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওই ফেসবুক পোস্টটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভাইরাল করা হয়। অপরাধীরা সংঘবদ্ধ বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এটা প্রমাণ করে অপরাধী চক্র নিজেরাই ফেসবুকে এ ধরনের ছবি পোস্ট করে সেটা ভাইরাল করার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন মৌলবাদী চক্রের সংগঠিত হওয়ার তৎপরতা টের পেয়েও তাদের থামানোর উদ্যোগ নেয়নি। বরং সমাবেশ করার অনুমতি দিয়ে সহায়তা করেছে। ফেসবুক পোস্টটি যে অপরাধী চক্র উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়িয়েছে, তাও দায়িত্ব নিয়ে জনগণকে ব্যাখ্যা করার কোনো চেষ্টা করেনি স্থানীয় প্রশাসন।’ তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এ অবস্থায় ফেসবুককে দায়ী করা কতটা যুক্তিসঙ্গত?’
সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করেন পুলিশের এমন একজন কর্মকর্তা জানান, ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ব্যক্তিবিশেষকে হয়রানি করা কিংবা অন্যের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে বিকৃত পোস্ট দিয়ে উত্তেজনা ছড়ানোর মতো ঘটনার ক্ষেত্রে ভুয়া অ্যাকাউন্ট যিনি খুলেছেন, যিনি অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেছেন, তার পরিচয় নির্ধারণ করাটা একটি বড় সমস্যা। ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে ই-মেইল করা হলে তারা শুধু হত্যাজনিত ঘটনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট কিংবা পোস্ট সম্পর্কে দ্রুত তথ্য দেয়। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে দ্রুত তথ্য দেয় না। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট চুক্তি না থাকার কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তথ্য পেতে সমস্যা হচ্ছে, মন্তব্য এই কর্মকর্তার।
এ ব্যাপারে প্রযুক্তিবিদ সুমন সাবির বলেন, ‘ফেসবুকের নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী নেটওয়ার্কটি অ্যাকাউন্টধারীদের সবার সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় চুক্তিবদ্ধ। ফলে কোনো অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে অভিযোগ এলে গুরুতর কোনো আলামত না পেলে ফেসবুক তথ্য দেয় না কিংবা অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয় না।’
অসচতেনতাই প্রধান সংকট :প্রযুক্তিবিদ সুমন সাবির বলেন, ‘ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর অসচেতনতার কারণে অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়, এমনকি ভুয়া অ্যাকাউন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন কাউকে বন্ধু তালিকায় যোগ করতে গেলে তার অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে যথাযথ তথ্য জানা জরুরি। সবার প্রথমে জানা উচিত, অ্যাকাউন্টধারী আপনার পরিচিত কি-না। সচেতন হলে কোনোভাবেই ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে কেউ বন্ধু পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘ফেসবুক ব্যবহারের সময় কোনো লিংকে ক্লিক করার ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে।’ এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পরিচিত জনকে ফোন করে নিশ্চিত হওয়া উচিত বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, পাসওয়ার্ডের ব্যাপারে খুব সচেতন হওয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হ্যাকাররা অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে পাসওয়ার্ড হাতিয়ে নেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফেসবুক, সাইবার স্পেস এবং প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে নিয়মিত সচতেনতা সৃষ্টি করার দায়িত্ব সরকার এবং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের।’
যে সব বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি :বিশেষজ্ঞদের মতে, ফেসবুকে আরও কয়েকটি বিষয়ে সচেতন থাকা খুব জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে প্রাইভেসি সেটিং। নিজের ছবি, টাইমলাইন পোস্ট এবং ট্যাগিং-এর বিষয়টিতে প্রাইভেসি সেটিংয়ের মাধ্যমে কাস্টমাইজ করা কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি।
এ ছাড়া ফেসবুকের সেবা নিয়ে যেসব বিভ্রান্তি আছে, সে সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে। যেমন, ফেসবুক কখনই তার থিমের রঙ পরিবর্তন, কতজন আপনার প্রোফাইল দেখছে, কতজন ভিজিট করেছে, কতজন আপনাকে আনফ্রেন্ড করেছে কিংবা ফেসবুক টপ স্টার ইত্যাদি জাতীয় অ্যাপ দেয় না। তাই এ-সংক্রান্ত তথ্য বা সেবা পাওয়ার জন্য কোনো অ্যাপ কিংবা লিংক কেউ পাঠালে তা অবশ্যই ভুয়া হবে। অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার জন্যই এ জাতীয় জিনিস পাঠানো হয়।