নায়ক মিরাজ

Slider খেলা

0d6960cd0b88099bb52dcbba7899df2f-c_03

ঢাকা;   ইতিহাস গড়া সবাই দেখে ফেলেছেন। টেলিভিশন, অনলাইন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সৌজন্যে সে ‘ইতিহাসের’ খুঁটিনাটিও এতক্ষণে আপনাদের জানা। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে কাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রোমাঞ্চকর যা যা ঘটে গেল, সেগুলো নিয়ে নতুন আর কিছু বলার নেই। ইতিহাসের সাক্ষী গোটা দেশই।

বালক-বীর মেহেদী হাসান মিরাজের হাত ধরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়টা এল দুই দিন বাকি থাকতে। ১০৮ রানের বড় ব্যবধান সেটিতে পরিয়ে দিয়েছে গৌরবের সোনালি মুকুট। আনন্দে ভেসেছে দেশ। কিন্তু সিরিজটা শেষ পর্যন্ত ১-১-এ ড্র হলেও চট্টগ্রাম টেস্টে তীরে এসে তরি ডোবার ক্ষত হতাশা জাগায়। আহা, টেস্ট সিরিজটা তো বাংলাদেশ ২-০-তেই জিততে পারত! আরেকটু পেছনে গেলে হতাশাটা আরও তীব্র হয়। ওয়ানডে সিরিজে প্রথম ও শেষ ম্যাচে জয় ধরা দিতে দিতেও দেয়নি। ভাবুন একবার, সব ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ যদি সিরিজটাকে ৫-০ করে ফেলতে পারত, উত্সবের আলোকোজ্জ্বল শিখা আজ কোথায় গিয়ে ঠেকত!

এই হতাশা, এই আফসোসও ঢাকতে পারছে না ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ের আনন্দ। বাংলাদেশ আগেও টেস্ট জিতেছে সাতটি। কিন্তু ওসবের প্রতিপক্ষ ছিল দুর্বল জিম্বাবুয়ে আর ভগ্নদশা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। ইংল্যান্ডের মতো বাহুবলী টেস্ট দলকে হারানোর তৃপ্তি তাতে মেলেনি।

শেরেবাংলা স্টেডিয়াম তাই ভাসল আনন্দের বন্যায়। মাঝমাঠে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বানানো খেলোয়াড়দের মানববৃত্ত দেখাল নতুন এক উদ্‌যাপন।

ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকুর রহিম সোজাসাপ্টাই বলে দিয়েছেন, তাঁর মতে এটাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় জয়। মুঠোফোনে সহ-অধিনায়ক তামিম ইকবালের কণ্ঠেও সেই তৃপ্তি, ‘আমার মতে, এর চেয়ে বড় জয় আর কোনোটাই নয়। সব ধরনের সংস্করণ মিলিয়েই এটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে স্মরণীয় জয়।’ বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা-প্রধান আকরাম খান তো সমালোচকদের মৃদু জবাব দেওয়ার উপলক্ষই বানিয়ে ফেললেন মিরপুর টেস্টের জয়কে, ‘সবচেয়ে ভালো লাগছে যারা আমাদের টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে সমালোচনা করে, তাদেরই আমরা টেস্টে হারালাম।’

জয়ের ভেতর মিশে থাকা উত্থান-পতনগুলোর উল্লেখ এখন বাহুল্য মনে হচ্ছে। ৫৮ রানে শেষ ৬ উইকেটের পতনে আরও একবার বেদনাময় ব্যাটিং বিপর্যয়, ২৭৩ রানের জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নেমে চা-বিরতির মধ্যেই বিনা উইকেটে ইংল্যান্ডের ১০০ রান করে ফেলা এবং ফিল্ডারদের দু-একটি ক্যাচ ফেলার ঘটনায় এখন আর কিছুই যায়-আসে না। জয়ের দিনে সবই জয়ের অনুঘটক, সাফল্যের রঙিন পাপড়ি। চাঁদেও যেখানে কলঙ্ক আছে, এটা তো একটা খেলা! উত্থান-পতন না থাকলে টিকিট কেটে এই রোমাঞ্চ দেখতে আসা কেন? ব্যর্থতার অলিগলি পেরিয়ে সাফল্যের দেখা পাওয়াটাই বেশি আনন্দের।

কিন্তু প্রতিটি জয়েই বিশেষ দ্রষ্টব্য হওয়ার দাবি রাখে কিছু ব্যক্তিগত সাফল্য। মিরপুর টেস্টের অনবদ্য জয়ে যেমন দ্যুতি ছড়াচ্ছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। দুই ইনিংসেই ৬ উইকেট করে নিয়ে তরুণ এই অফ স্পিনার ম্যান অব দ্য ম্যাচ তো বটেই, চট্টগ্রাম টেস্টের ৭ উইকেটসহ মোট ১৯ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য সিরিজও। কাল চা-বিরতির পর এক সেশনেই ইংল্যান্ডের ১০ উইকেট উপড়ে ফেলার তিনিই মূল নায়ক। এই সেশনের প্রথম বলেই বেন ডাকেটের স্টাম্প ভেঙে দেন মেহেদী। বাকি ৪ উইকেট নিয়ে পার্শ্বনায়ক সাকিব আল হাসানের আঘাতটা আসে পরের ওভারের প্রথম বলে। এবার শিকার জো রুট। পরে হ্যাটট্রিকের সুযোগ তৈরি করেও পারেননি, তবে বাকি তিনটি উইকেটই সাকিব নিয়েছেন এক ওভারে। এর প্রথমটি আবার বেন স্টোকসের, ১৩৯ রানে ৬ উইকেট পড়ার পর ক্রিস ওকসের সঙ্গে যিনি জমিয়ে ফেলছিলেন ভয়ংকর এক জুটি।

সাকিবের উদ্‌যাপনই বলে দিচ্ছিল কতটা স্বস্তির ছিল ওই উইকেট। স্টোকসকে বোল্ড করেই স্যালুট ঠুকলেন। কাকে এবং কেন, সেটা এক রহস্য। তবে মুশফিকের ধারণা, উইকেট পাওয়ার পর বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের উদ্‌যাপনে বাড়াবাড়ি না করার যে পরামর্শ আম্পায়াররা এর আগে দিয়েছেন, সাকিব হয়তো সেটাকে সম্মান দেখিয়েই স্যালুট ঠুকেছেন। এটি হতে পারে নির্বাক উদ্‌যাপনের ‘সাকিবীয়’ ভঙ্গি।

বিপর্যয়ের মধ্যে অলংকার ছিল ব্যাটিংয়েও। উত্তুঙ্গ ফর্ম ধরে রেখে ইমরুল কায়েসের ৭৮ সেটির অগ্রভাগে। সাকিবের ৪১ রানের ইনিংসটি দেখতে হয়তো মনোহর ছিল না। আউটের সহজ সুযোগ দিয়ে বেঁচে গেছেন দু-একবার, কিন্তু এই ৪১ না হলে কি দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ তিন শর কাছাকাছি যেত? সাব্বির রহমানের ১৫ আর শুভাগত হোমের অপরাজিত ২৫ রানও দারুণ চালিকাশক্তি হলো ইনিংসের শেষ ভাগে। তা না হলে ২৭২ রানের লিড কেবল স্বপ্নই ছিল। ইংল্যান্ড থেকে যেতে পারত নিরাপদ।

ভালো কথা, সিরিজের আগে, এমনকি সিরিজ চলাকালীনও সবচেয়ে আলোচিত শব্দ তো ওটাই ছিল—নিরাপত্তা! সিরিজ শেষে বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড সব শিবিরেই নিরাপত্তা রক্ষায় সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রশংসা। কিন্তু ইংল্যান্ড দল তা মন থেকে বলল কি না কে জানে! এই সিরিজেই যে তারা আবিষ্কার করল, বাংলাদেশে আসল জায়গাতেই এখন আর কেউ নিরাপদ নয়। জায়গাটা ক্রিকেট মাঠ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *