গাজীপুর; ৩৯ টি লাশ উদ্ধার হওয়া টঙ্গীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত টাম্পাকোর তিন কোটি টাকার মালামাল বা ওয়েস্টেজ লুটপাটের অভিযোগে টঙ্গী মডেল থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ বলছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়রের মালিকানাধীন একটি কারখানার বাউন্ডারির ভেতর থেকে বিপুল পরিমাণ মালামাল জব্দ করেছে। তাৎক্ষনিকভাবে ভারপ্রাপ্ত মেয়র গনমাধ্যমকে বলেছিলেন, কোন মালামাল চুরি হয়নি। বেশ দিন পর তিনি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, মিডিয়া মিথ্যা সংবাদ দিয়েছে। মিডিয়া থানায় দায়েরকৃত মামলা, পুলিশের বক্তব্য ও বাস্তবতার ভিত্তিতে স্বচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করেছে। কিন্তু মেয়র মামলার ইতিহাস ও ঘটনাস্থলের মালিকানার বিষয়ে কোন কথা বলেননি। বরং ঘটনার সময় তিনি বলেছেন, মালামাল চুরি হয়নি। ফলে এখন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের মিডিয়ার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন কি নিজের অপরাধ প্রমান করে কি না তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছে।
গনমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, লাশ উদ্ধার অভিযানের অংশ হিসেবে সেনা প্রকৌশলীরা ভারী যন্ত্রপাতির সাহায্যে টাম্পাকোর ধ্বংসাবশেষ অন্যত্র সরিয়ে রাখছিলেন। এ সময় সেখান থেকে টাম্পাকোর মূল্যবান মালামাল লুটে নেয় স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে টাম্পাকোর ভেতর থেকেও মালামাল লুট হয়। এসব মালামালের মধ্যে ছিল কারখানার ধ্বংসপ্রাপ্ত মেশিনপত্র, বিভিন্ন অবকাঠামোর রড, ইট, প্লাস্টিক দানা বা বিভিন্ন কাঁচামাল, কাগজের রুল, সেনিটারি ফিটিংস এবং লোহাসহ বিভিন্ন মূল্যবান দাতব পদার্থ। টাম্পাকোর উদ্ধারকাজে সেনা প্রকৌশল বিভাগকে সহযোগিতা করছে দমকল বাহিনী ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশন প্রদর্শিত নির্ধারিত তিনটি স্থানে টাম্পাকোর ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে রাখা হচ্ছিল। সবচেয়ে বেশি মালামাল বা ওয়েস্টেজ রাখা হয় স্থানীয় পাগাড় এলাকায় গাসিক ভারপ্রাপ্ত মেয়রের একটি কারখানার সামনে আবাসন প্রকল্পের উন্মুক্ত প্লটে। পরে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের চাচা পরিচয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আসগর হাজী দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক দিয়ে এসব মালামাল নিজের বাড়ির ভেতর ও ভারপ্রাপ্ত মেয়রের কারখানার বাউন্ডারির ভেতর স্থানান্তর করেন। সেখান থেকে এসব মালামাল টঙ্গীর পুরাতন লৌহ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। অপর দিকে নিমতলি রেলগেট সংলগ্ন টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের পাশে এবং আমতলি রেল জংশন এলাকার খালি জায়গায়ও টাম্পাকোর ধ্বংসাবশেষ রাখা হয়। নিমতলির মালামালও প্রভাবশালীরা অন্যত্র বিক্রি করে দেন। ক্রেতারা অধিকাংশ মালামাল সেখান থেকে ইতোমধ্যে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। আমতলির মালামাল বিক্রি করা হলেও ক্রেতারা ভারী যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে না পারায় এখনো এসব মালামাল সেখান থেকে সরাতে পারেননি। এ অবস্থায় টাম্পাকোর একজন নিরাপত্তা প্রহরী ওয়াজেদ মোল্লা লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার এবং কারখানার মূল্যবান সম্পদ রক্ষার্থে টঙ্গী মডেল থানায় একটি মামলা নং-৫ দায়ের করেন। মামলায় তিন কোটি টাকার মালামাল চুরির অভিযোগ আনা হলেও এজাহারে সুনির্দিষ্ট করে কারোর নাম উল্লেখ করা হয়নি বলে টঙ্গী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ ফিরোজ তালুকদার জানান।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা টঙ্গী মডেল থানার ওসি (অপারেশন) আলমগীর হোসেন জানান, কারখানায় উদ্ধার অভিযান চলাকালে চোরের দল কৌশলে কারখানার মালামাল চুরি করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। মালামাল গাসিক ভারপ্রাপ্ত মেয়রের গোডাউন থেকে জব্দ করা হয়েছে। এ চক্রের সাথে যারা জড়িত তদন্ত সাপেে তাদের অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো: আসাদুর রহমান কিরনের মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মালামালগুলো চুরি হয়নি। এগুলো রাখার নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় আমার নিজস্ব জায়গায় রাখা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে থানায় মামলা হওয়ায় উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া সেনাবাহিনী এবং গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নির্দেশে কারখানা কর্তৃপরে হেফাজতে মালামালগুলো ফেরত দেয়া হচ্ছে।
গতকাল রোববার গাসিকের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ টঙ্গীতে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে করে মিডিয়াকে দোষারোপ করেছে। সিটি করপোরেশনের টঙ্গী অঞ্চলের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। এসময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন এসময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সকল কাউন্সিলর, টঙ্গী ও গাজীপুর সাংবাদিকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মেয়র বলেন, গত ৬ অক্টোবর ২০১৬ইং তারিখে একাধিক মিডিয়ায় আমাকে জড়িয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ওই সংবাদ সম্পূর্ন মিথ্যা ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যেপ্রনোদিত বলে তিনি দাবী করেন। মানহানী করার লক্ষেই এ ধরণের মিথ্যা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যার কোন ভিত্তি নেই।
লিখিত বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, জনগনের ভালোবাসায় ও তাদের ভোটে তিনি বার বার নির্বাচিত হয়েছেন। জনগনের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্বও তার। জনগন সবসময় তার পাশে আছে, এটাই তার শক্তি। যা কিনা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছে হিংসার কারন। প্রতিপক্ষরা তার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে রাজনৈতিক মর্যাদায় ঈর্শ্বাণিত হয়ে বিভিন্ন কুৎসা রটাতে ব্যস্ত রয়েছে। যা কিনা তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বহি:প্রকাশ বলে তিনি দাবী করেন।
উল্লেখ্য, গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকায় সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ড. সৈয়দ মকবুল হোসেনের মালিকানাধীন টাম্পাকো ফয়েল কারখানায় ১০ সেপ্টেম্বর সকালে বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। এতে প্রতিষ্ঠানটির চারটি ভবনের তিনটি ধসে পড়ে। ঘটনার পর একটানা দীর্ঘ ৪ দিন ফায়ার সাভির্সের ২৫টি ইউনিট রাতদিন চেষ্টা চালিয়ে ওই কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন নিয়ন্ত্রণের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সদস্যরা উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। এ দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সচেতন মহলের মতে, ভারপ্রাপ্ত মেয়র সাংবাদিক সম্মেলন করে মিডিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কিন্তু মামলা ও পুলিশের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেননি। এতে প্রমানিত হয় মেয়র নিজের অপরাধ আঁড়াল করতে মিডিয়ার উপর দোষারোপ করছেন কি না তা তদন্তের দাবি রাখে।