দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

Slider লাইফস্টাইল সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী

35206_f4

 

ভু  ল ধারণায় গড়া কুসংস্কারের শেকড় উপড়ে ফেলার আহ্বান জানিয়ে এবার বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে বলা হচ্ছে মানসিক রোগীদের মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কুসংস্কারের কারণে মানসিক রোগীরা সমাজে যথাযথ মূল্য পায় না; অবহেলার শিকার হয়। ফলে তাদের রোগভোগ দীর্ঘায়িত হয়। কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে মানসিক রোগীরা কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকে আছে এখনো। এ ব্যাপারে সমাজের সবার দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই বদলাতে হবে। বৈজ্ঞানিক সত্যের আলোকেই প্রচলিত মিথগুলো ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে সবাইকে। সুস্থ সমাজ গড়ার জন্য এটি জরুরি বিষয়। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ-এর ঘোষণাপত্র থেকে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি চারজনের একজন জীবনের কোনো না কোনো সময় মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেন। তাদের অধিকাংশই কুসংস্কারের কারণে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন না বা চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন। এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বলা হচ্ছে- যারা মনোজাত জরুরি সংকটে আছেন, তাদের জন্য মানবিক ও সহযোগিতাপূর্ণ প্রায়োগিক প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি সংকটে আক্রান্ত মানসিক রোগীদের মর্যাদা রক্ষায় এটিই এ বছরের প্রতিপাদ্যের ‘সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড’-এর মূল কথা।
মনে রাখতে হবে, বর্তমানে উন্নত বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে মনন ও সৃজনশীলতার প্রতিটি ফ্যাকালটিরই উন্নতি সম্ভব। এর সাহায্যে রোগীকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখা যায়। কর্মসংস্থানই রোগীর পুনর্বাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। রোজগারের উৎস হাতে থাকলে রোগীর মনোবল বাড়ে, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ দৃঢ় হয়। ফলে উৎপাদনও বাড়ে। আর উৎপাদন বাড়লেই অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। এভাবে চিকিৎসাপ্রাপ্ত রোগীরা সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু সুস্থ রোগীরা বেকার থেকে গেলে তার চিকিৎসা ব্যাহত হয়। রোগের পুনরাক্রমণ ঘটতে পারে। তাই ২০০০-০১ সালে বলা হয়েছিল ‘বেকারত্ব ও মানসিক রোগ : কর্মসংস্থানই পুনর্বাসন’। সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য বিষয়টি মানসিক রোগীদের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এবারও মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে সহায়তা করার আহ্বান এসেছে। আমরা আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, বর্তমান সরকার অটিজম ও প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা বরাদ্দ করে যেভাবে কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করছে, তা বিশ্বময় প্রশংসনীয় এক মানবিক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
আজ ক্রমাগতভাবে প্রচার পেয়ে এসেছে সিজোফ্রেনিয়াসহ অধিকাংশ গুরুতর মানসিক রোগীই হিংস্র, আক্রমণাত্মক, চারপাশের জনসাধারণের জন্য বিপজ্জনক এবং এরা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যে কোনো সময় তারা যে কোনো বিপত্তি ঘটিয়ে ফেলতে পারে। নানা ঢঙে, নানা রঙে মানসিক রোগীদের এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যুগে যুগে; এমনকি বর্তমানেও। তিলকে তাল করে মানসিক রোগীর আচরণকে ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু ধারণাটি মোটেও সঠিক নয়। কেবল ড্রাগ আসক্তিতে আক্রান্ত মানসিক রোগীরাই সাধারণ জনগোষ্ঠীর চেয়ে বেশি হিংস্র আচরণ করতে পারে। অধিকাংশ হিংস্রতার সঙ্গে প্রধানত জড়িত রয়েছে উদ্দাম ও বেপরোয়া তারুণ্য, মাদকাসক্তি, আগে ভায়োলেন্সের সঙ্গে জড়িত থাকার ইতিহাস। নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যেই সহিংসতা বেশি দেখা যায়। প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রে সন্দেহ বা তাদের অলীক প্রত্যক্ষণের কারণে বিচ্ছিন্ন অ্যাগ্রেশন দেখা গেলেও তা কোনোভাবে ‘জেনারালাইজড’ করা যাবে না। যেসব মানসিক রোগী গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের অধিকাংশই সঠিক সময়ে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পায়নি। দীর্ঘদিন বিনা চিকিৎসার কারণে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। এদের বিবেচনায় রেখে সব ধরনের মানসিক রোগের ব্যাপারে ‘ইনফারেন্স’ টানা অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক। মনে রাখতে হবে, সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এসব রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করা যায়। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে যায় না তাদের। অল্প কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া তারা নিয়ন্ত্রিতই থাকে। দীর্ঘদিনের অসুস্থ রোগীকে মানুষ অনিয়ন্ত্রিত ভাবতে শেখে, ভুল শিক্ষণ থেকে তখন মানুষের মনে গেঁথে যায় নেতিবাচক ইমেজ। একজন স্বাভাবিক মানুষের সহিংসতা, অনিয়ন্ত্রিত ধ্বংসাত্মক আচরণের তুলনায় মানসিক রোগীরা অনেক বেশি সহজ-সরল, জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক বেশি নিরাপদ।
কিন্তু এক গবেষণায় দেখা গেছে, টিভিতে প্রদর্শিত ৭২ শতাংশ মানসিক রোগীকে দেখানো হয় হিংস্র আচরণের প্রতিভূ হিসেবে। এই অজ্ঞতা ও নির্মমতার চিত্র এখানেই শেষ নয়। বিভিন্ন উপন্যাসের পেপার ব্যাকে মানসিক রোগীদের উপস্থাপন করা হয় ক্ষমাহীন জঘন্য ঘাতক হিসেবে। জনপ্রিয় অনেক মুভিতেও মানুষকে ধারণা দেয়া হয় মানসিক রোগী মানেই ভিলেনের মতো হিংস্র। ফলে সমাজের মানুষ অসহায় রোগীদের ভয় পেতে শুরু করে। সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে তাদের পরিহার করে চলে।
আরেকটি মিথ হচ্ছে মানসিক রোগ শারীরিক রোগের মতো কোনো অসুস্থতা নয়। এই রোগ ঘটে থাকে জিন, ভূত, পরীর আছর বা কুপ্রভাব থেকে। প্রকৃতপক্ষে রক্ত পরীক্ষা কিংবা বায়োপসি করলে ক্যানসার ধরা পড়ে। ইসিজি বা ইকোকার্ডিওগ্রাম করলে হৃদরোগ ধরা পড়ে। শারীরিক এসব রোগ নির্ণয় করার জন্য সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। কিন্তু বায়োলজিক্যাল কারণ থাকলেও মনোরোগ নির্ণয় করার এ ধরনের কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষা তেমন নেই বললেই চলে। না থাকলেও গুচ্ছ উপসর্গের মাধ্যমে এই রোগ ধরা হয়। হঠাৎ অস্বাভাবিক আচরণের ব্যাখ্যাও তাই যুগে যুগে নানাভাবে এসেছে। ধরে নেয়া হয়েছে জিন-ভূতই এর অন্যতম কারণ। আছর বা কুপ্রভাব থেকে মানসিক রোগ হয়- এমন অজুহাতে রোগীকে দিনের পর দিন শারীরিকভাবে অনেক টর্চার করা হতো। এখনো চলছে একই প্রথা। মূলত মানসিক রোগের কারণ হিসেবে বায়োলজিক্যাল, সাইকোলজিক্যাল ও সোশ্যাল সমস্যাই দায়ী- এটি ‘মাল্টিফ্যাক্টোরিয়াল’ বা অনেক কারণের মিথস্ক্রিয়ায় ঘটে থাকে; জিন-ভূত বা পরীর আছরে এই রোগ সৃষ্টি হয় না।
আরো প্রচলিত ধারণা হচ্ছে মানসিক রোগ চিকিৎসার জন্য রোগীকে আলাদা প্রতিষ্ঠানে আটকে রাখতে হবে। কিন্তু এটি অতীতের ধারণা। সাম্প্রতিক সময়ের দাবি, ‘জেনারেল হাসপাতাল ওরিয়েন্টেড চিকিৎসাসেবা’। দূরবর্তী জনবিচ্ছিন্ন লোকালয়ের কোনো প্রতিষ্ঠানে আটকে রেখে চিকিৎসা চালানোর ‘ব্যাকডেটেড’ ব্যবস্থা আজ বদলে গেছে। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্লোগান হচ্ছে- ‘স্টপ এক্সক্লুশন, ডেয়ার টু কেয়ার’ অর্থাৎ দূরে ঠেলে নয়, কাছে রেখেই চিকিৎসা করতে হবে মানসিক রোগীদের। অনেক উন্নত ওষুধও আবিষ্কৃত হয়েছে এখন। গড়ে উঠছে নানা সেবা প্রদানকারী সংস্থা। সাইকোলজিক্যাল ও সোশ্যাল ট্রিটমেন্ট পদ্ধতিও এখন অনেক ভালো। রোগীর চিকিৎসার বড় একটি অংশ হচ্ছে পুনর্বাসন। সুস্থতার পর চাকরির সুযোগ নিশ্চিত করা। দীর্ঘদিন, বছর বছর জনবিচ্ছিন্ন বদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা রোগীর জন্য ক্ষতিকর; ‘ইনসাইট’ বা হিতাহিত জ্ঞান, বাস্তবতার সঙ্গে রোগীর সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হলে রোগীর আত্মবিশ্বাস তখন ধ্বংস হয়ে যায়। অনেক রোগীই ভালো হওয়ার পরও দিনের পর দিন মানসিক হাসপাতাল পাবনায় পড়ে আছে, টিভি রিপোর্টিং ও পত্রিকার প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা যায়। আত্মীয়-স্বজন তাদের নিয়ে যেতে আসেন না। দিনের পর দিন অমানবিক মূল্যবোধের শিকার হয় তারা কুসংস্কারের কারণে।
আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকার জন্য চাই কাজ। জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন কাজ। মনের শান্তির জন্য কাজের বিকল্প নেই। কিন্তু কেবল প্রাচুর্য নয়, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সুস্থ মনও। সুস্থ মন ধরে রাখার একটি উপায় হলো কর্মে নিয়োগ লাভ। নিয়োগ প্রাপ্তির মাধ্যমে রোজগারের একটি নিয়মিত উৎস হাতে এসে যায়। জীবনের নানা অনুষঙ্গের প্রতি তখন আগ্রহ-উদ্দীপনা ও আত্মমর্যাদাবোধ বেড়ে যায়। নিজেকে সমাজের একজন দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করার মতো অনুপ্রেরণাও মনের মধ্যে জেগে ওঠে। কর্মে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ পেলে নিজের সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগও পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রেই উপার্জিত আয় ধর্তব্যে আসে না। কর্মের গুরুত্বই বড় হয়ে ধরা দেয়। উপার্জন না হলেও কাজের সুযোগ পেলে ব্যক্তিবিশেষের মনোবল ও নৈতিক শক্তি বেড়ে যায়।
একজন মানুষ সুস্থ ছিল। হঠাৎ করেই সে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে আবার সুস্থ হয়ে উঠেছে। আবার কাজ করার যোগ্যতা ফিরে পেয়েছে- সমাজ কি তাকে কাজ করার অধিকার দেবে? সরকার কি এদের কাজের সুযোগ রাখবে? বেসরকারি নিয়োগকর্তারা কি তাদের চাকরিচ্যুত করবে? সব ক্ষেত্রেই কাজ করার অধিকার কি সংকুচিত হয়ে যাবে? চাকরিকালীন অবস্থায় কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে কি তাকে বরখাস্ত করা উচিত? ডিমোশন দেয়া উচিত? বর্জন করা উচিত? নাকি চিকিৎসার মাধ্যমে তার যোগ্যতা রক্ষা করার কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত? এ প্রশ্ন জাতির কাছে।
বর্তমানে আমরা চারপাশে কী দেখতে পাই?
চারপাশে রয়েছে নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহতার এক করুণ চিত্র।
প্রায়ই মানসিক রোগীদের মৌলিক ইস্যুগুলো পদদলিত করা হয়। খাটো করা হয় তাদের যোগ্যতা। সুস্থ হওয়ার পরও আগের মান-মর্যাদা ও অধিকার ফিরে পায় না তারা। মনোরোগ ডায়াগনসিসের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক অজ্ঞতার শানিত চাবুক রোগীর পিঠে আঘাত হানে। কুসংস্কারের অন্ধ ছোবলে এভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায় অসংখ্য জীবন। মানসিক রোগের প্রতি মানুষের এই নেতিবাচক মনোভাব যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। এর বেশি শিকার হয়েছে গুরুতর মানসিক রোগীরা।
কেন গড়ে উঠেছে এই নেতিবাচক ধারণা?
মূলত এর জন্য অশিক্ষা ও কুসংস্কারই দায়ী। অবৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর ভর করেই ভুল সংস্কার ডালপালা বিস্তার লাভ করেছে। সমাজে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। সম্ভাব্য নিয়োগকারীরাও এই ধারণার ঊর্ধ্বে নয়। তাদের পরিকল্পনা থাকে উৎপাদন বাড়ানো, দক্ষ কর্মী নিয়োগ। মানসিক রোগীরাও যে দক্ষ কর্মী হতে পারে, এটি তাদের ধারণার বাইরে। প্রচলিত বিশ্বাসের কারণেই এ ধরনের কাউকেই তারা কাজ দিতে রাজি নয়। ফলে মানসিক চিকিৎসা পেয়েছে- এমন রোগীরা কাজ জোটাতে পারে না। কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী এই বেহাল অবস্থা বিরাজমান। কিন্তু সাম্প্রতিককালের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, উন্নত ওষুধ ব্যবহার ও পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত কমিউনিটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে গুরুতর মানসিক রোগীদের সুস্থ রাখা যায়। কাজে নিয়োগ লাভের মতো সামর্থ্য বাড়ানো যায়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো চিকিৎসার পাশাপাশি কমিউনিটিতে সেবা প্রদানের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। কর্মে নিয়োগ লাভ মানসিক রোগ চিকিৎসার একটি মৌলিক অংশ। বিষয়টি সবাইকে মনে রাখতে হবে।
কোনো মানসিক রোগীই মূল্যহীন নয়। তাদের সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যায় না। নানা তীর্যক বাক্য ব্যবহার থেকে বিরত থেকে এদের প্রশংসা করতে হবে যে কোনো সাফল্যে। তখনই তাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ বেড়ে যাবে। সুস্থ সমাজ গঠনে বিষয়টির গুরুত্ব কিন্তু কম নয়।
গবেষণায় আরো দেখা যাচ্ছে, ডিপ্রেশনের কারণেই কর্মসময়ের বেশি অপচয় ঘটে। বিশ্বের অর্থনৈতিক অগ্রগতি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এসে দাঁড়াচ্ছে ডিপ্রেশনের কারণেই। বিশ্বব্যাপী ডিপ্রেশনের প্রকোপ এতই দ্রুত বাড়ছে যে, হৃদরোগের চেয়ে ডিপ্রেশনকেই এখন মানব গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় বোঝা হিসেবে ধরা হচ্ছে।
নানা কারণে জনগোষ্ঠী মানসিক রোগ চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক পথে এগিয়ে আসতে পারে না। বাংলাদেশ জার্নাল অব সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ৮০.৬৫ শতাংশ গুরুতর মানসিক রোগীই প্রথম দিকে সনাতন চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করে। এতে তাদের ৮০ শতাংশেরই কোনো উপকার হয়নি। একজন রোগীকে সর্বোচ্চ ৯ ধরনের সনাতন পদ্ধতির চিকিৎসা দেয়া হয়। এদের মধ্যে ১৯.৬ শতাংশ রোগীর ব্যয় হয় গড়ে ৫ হাজার টাকা। একজন রোগী সর্বোচ্চ ব্যয় করে ৪ লাখ টাকা (আলম, হক ’৯৮)।
রিপোর্র্র্র্র্টের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিক্ষা, ধর্ম, উচ্চ বা নিম্নশ্রেণি সবার ক্ষেত্রেই মানসিক রোগ চিকিৎসার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় একই রকম। সবাই প্রথম সনাতন পথেই এগিয়ে যায়। এরা বৈদ্য, কবিরাজ, খোনকার, পীর সাহেবদের কাছে ধরনা দেয়, মাজার বা মন্দিরে মানত করে, ঝাড়ফুঁক-তাবিজ ব্যবহার করে। ধোঁয়া দিয়ে শ্বাস টানতে বাধ্য করা, লাউ কাটা, জিন হাজির থেকে শুরু করে শারীরিক নিবর্তনমূলক অনেক ধরনের অমানবিক পদ্ধতি আরোপ করা হয় রোগীদের ওপর।
মানুষের মনে গড়ে ওঠা ভুল ধারণাগুলো ভাঙতে হবে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। একইসঙ্গে প্রতিটি দেশে মানসিক চিকিৎসাসেবার বৈজ্ঞানিক প্ল্যাটফরমটিও উন্নত করতে হবে।
মনে রাখা দরকার, মানসিক রোগ মানেই লজ্জার কোনো কারণ নয়। মানসিক রোগ শারীরিক রোগের মতোই অসুস্থতা। সব মানসিক রোগেরই বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা সম্ভব। বর্তমানে অনেক উন্নত ও কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর সুষ্ঠু ব্যবহারে রোগও পুরোপুরি সেরে যাচ্ছে। রোগীরা কর্মক্ষম থাকতে পারছে। কোনো কোনো রোগীকে দীর্ঘদিন ওষুধ খেতে হয়, যেমনটি খেতে হয় অনেক শারীরিক রোগীদেরও, যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ইত্যাদি রোগে প্রায় সারা জীবনই ওষুধ গ্রহণ করে যেতে হয়। আবার অধিকাংশ মানসিক রোগীকেই দীর্ঘদিন ওষুধ খেতে হয় না। মানসিক চিকিৎসাসেবার মান এমনিভাবে নানা আঙ্গিক থেকে সফলতার দিকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।  মনোচিকিৎসার পদ্ধতিগুলোও অনেক উন্নততর হয়েছে। বর্তমান সরকারও অটিজমসহ অন্যান্য মানসিক সমস্যা এবং চিকিৎসার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, প্রধানমন্ত্রীর অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারবিষয়ক উপদেষ্টা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সচেতনতার আন্দোলন জোরদার হয়েছে। আশা করি দ্রুতই আমরা নির্মাণ করতে পারবো কুসংস্কারমুক্ত সমাজ, দেশ ও বিশ্ব। জরুরি সংকটে আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়ে তার বিধ্বস্ত অবস্থা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করতে হবে। তার মর্যাদা রক্ষায় এর চেয়ে বড় মানবিক বিষয় আর নেই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সাইকোথেরাপি, এনআইএমএইচ (জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *