জীবন-মত্যুর সন্ধিক্ষনে খাদিজা

Slider নারী ও শিশু ফুলজান বিবির বাংলা

1280f2359ae7345c8e919c6d20e7ff27-96_sylhet-kadiza-pic-001

ঢাকা; পরীক্ষা চলছে। যে পথ ধরে খাদিজা বেগমের পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা ছিল, সে পথের ওপর এখন তাঁরই রক্তের ছোপ। সংকটাপন্ন অবস্থায় খাদিজা এখন শুয়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়।

সিলেটে ছাত্রলীগ নেতার হামলার শিকার খাদিজা বেগমের দ্বিতীয় দফা অস্ত্রোপচার হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে। নিউরোসার্জারি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক রেজাউস সাত্তারের অধীনে তাঁর চিকিৎসা চলছে। রেজাউস সাত্তার গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খুব সংকটাপন্ন অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে রিসিভ করেছি। এখন ইলেকটিভ ভেন্টিলেশনে আছেন (লাইফ সাপোর্ট)। তাঁর মাথায় ও দুই হাতে অসংখ্য কোপের ক্ষত। খুব জটিল অস্ত্রোপচার হয়েছে খাদিজার। এ ধরনের রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৫ শতাংশ। ৭২ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।’

রাত ১২টা ৫০ মিনিটে স্কয়ার হাসপাতালের কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস কর্মকর্তা গোলাম মওলা বলেন, খাদিজার অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। চিকিৎসকের দেওয়া ৭২ ঘণ্টা সময় শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।

খাদিজা সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক (পাস) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। গত সোমবার পরীক্ষা দিতে সিলেটের এমসি কলেজে গিয়েছিলেন তিনি। পরীক্ষা শেষে ফেরার সময় এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে খাদিজাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন ছাত্রলীগের নেতা বদরুল আলম (২৬)। বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করছিলেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেউ কেউ খাদিজাকে কোপানোর দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করেন। সেই ভিডিওটি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার নৃশংসতায় শিউরে উঠে নিজেদের মতামত প্রকাশ করছে হাজারো মানুষ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্কুলছাত্রী কণিকা ঘোষ, ঢাকার সুরাইয়া আক্তার রিসা ও মাদারীপুরের নিতু মণ্ডলের পর খাদিজার ওপর বখাটে ও উত্ত্যক্তকারীদের একই ধরনের হামলার ঘটনায় উৎকণ্ঠা বেড়েছে সারা দেশে। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, অপরাধীদের বিচার না হওয়ার কারণেই এমন ঘটনা বাড়ছে।

অবশ্য অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে খুবই স্পষ্ট। তিনি কাউকে ছাড় দেন না। আমি আপনাদের জোর গলায় বলতে পারি, যে-ই অপরাধ করেছেন, সেই অপরাধীকে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।’

খাদিজা যে কলেজে পড়েন এবং যে কলেজ ক্যাম্পাসে ঘটনা ঘটেছে, সেই দুই কলেজেরই ছাত্রী ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। গতকাল রাতে তিনি বলেন, ‘একই কলেজে আমিও পড়েছি, আমি সেখানে নিজেকে ভাবছি! কী নির্মম, আমি ভিডিওটা পুরো দেখতে পারিনি। আমাদের খাদিজা বেঁচে আমাদের মাঝে ফিরে আসুক।’ তিনি বলেন, তারা ধরেই নিয়েছে এ ধরনের সন্ত্রাস যারা করে, ওই সন্ত্রাসীরা বিচারের ঊর্ধ্বে। এমন বর্বরতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তিনি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হামলাকারীর বিচার দাবি করেন।

মুঠোফোনে ধারণ করা খাদিজাকে কোপানোর ভিডিওতে দেখা যায়, মাটিতে পড়ে থাকা খাদিজাকে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করছেন বদরুল। ভিডিওতে অনেকের চিৎকার, কান্নাকাটির শব্দ শোনা গেলেও কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে যাননি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, কয়েকজন এগোনোর চেষ্টা করতেই চাপাতি হাতে বদরুল তাঁদেরও আঘাত করতে ছুটে আসেন। কয়েকজন দূর থেকে ঢিল ছুড়ে তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। এরপর বদরুল চাপাতি হাতে পালানোর সময় ছাত্ররা তাঁকে ধাওয়া দেয়। একপর্যায়ে ছাত্ররা তাঁকে ধরে ফেলে। সেখানে তিনি পিটুনির শিকার হন। পরে তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

কলেজছাত্র ও স্থানীয় জনতা রক্তাক্ত খাদিজাকে দ্রুত সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। অবস্থার অবনতি হলে সোমবার রাতে অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা দেন স্বজনেরা। গতকাল সকালে তাঁকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

খাদিজার প্রতিবেশী ও স্বজনেরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করছিলেন বদরুল। ২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারিও উত্ত্যক্ত করার সময় স্থানীয় ব্যক্তিরা বদরুলকে ধরে পিটুনি দেন। পরদিন বদরুল তাঁকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন জালালাবাদ থানায়। মারধরকারীদের জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই মামলার এক আসামি  বলেন, উত্ত্যক্ত করার জন্যই যে তাঁকে মারধর করা হয়েছিল, তা সবাই জানত, পুলিশও। তারপরও ২০১২ সালের ৩১ মে ১৪ জনের নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন বদরুলের করা মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে তখন তিনি থানায় কর্তব্যরত ছিলেন না বলে তদন্ত ও ঘটনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ওই অভিযোগপত্র বদরুলের মনঃপূত হয়নি। এ নিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার পুলিশকে শাসিয়েছেন। গত সোমবার খাদিজাকে কোপানোর পেছনে সেই ঘটনার ক্ষোভ থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

গণপিটুনির শিকার হয়ে আহত বদরুল পুলিশ পাহারায় সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি  কাছে হামলার কথা স্বীকার করে বলেন, ঘটনার দিন দুপুর থেকেই তিনি খাদিজার বাড়ি ফেরার পথে অপেক্ষা করছিলেন।

বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি শেষ বর্ষের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। তবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন দাবি করেছেন, বদরুল সুনামগঞ্জের ছাতকে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কর্মজীবনে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্রলীগ থেকে বদরুলের পদ বাতিল হয়েছে। এটা তাঁর ব্যক্তিগত পাশবিকতা। তিনি বদরুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

গতকাল দুপুরে জাকির খাদিজাকে দেখতে স্কয়ার হাসপাতালে যান।

হামলার ঘটনায় খাদিজার চাচা আবদুল কুদ্দুস গতকাল হত্যাচেষ্টার অভিযোগে বদরুলের বিরুদ্ধে শাহপরান থানায় মামলা করেন। শাহপরান থানার ওসি শাহজালাল মুন্সি বলেন, এ মামলায় বদরুলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। হামলার কারণ জানতে তদন্ত চলছে। হামলায় ব্যবহৃত চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।

খাদিজার চাচা বলেন, খাদিজার বাবা মাশুক মিয়া সৌদি আরবপ্রবাসী, মেয়ের জখম হওয়ার খবর শুনে তিনি রওনা দিয়েছেন। আর মা মনোয়ারা বেগম অসুস্থ। মেয়েকে তিনি জীবিত ফেরত চান। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে খাদিজা দ্বিতীয়। সিলেটের জালালাবাদের আউশা গ্রামে খাদিজাদের বাড়ি।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *