ঢাকা; নৃশংস। বর্বর। অমানুষিক। কোনো একক শব্দে প্রকাশ করা যায় না এমন ঘটনা। প্রকাশ্যে কলেজছাত্রীকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার বর্বরতম এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হতবাক সিলেট। ক্ষুব্ধ সারা দেশের মানুষ। নির্মমতার শিকার খাদিজা বেগম নার্গিস এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তার জীবনে ফেরার তেমন কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না চিকিৎসকরা। তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। গতকাল ভোরে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় সিলেট থেকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে তাকে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে কয়েক ঘণ্টার অস্ত্রোপচার করেছেন চিকিৎসকরা। তাকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এদিকে খাদিজার ওপর নৃশংস বর্বর হামলার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে সিলেট। হামলাকারী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেতা বদরুল ইসলামের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ। এ ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সারা দেশে। এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে খাদিজাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। খাদিজাকে কোপানোর ঘটনায় অভিযুক্ত বদরুল ইসলামকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সঙ্গে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনায় খাদিজার চাচা বাদী হয়ে বদরুলকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন। এ ঘটনায় বদরুল ছাড় পাবে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
এদিকে দিনভর খাদিজাকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়েছেন চিকিৎসকরা। বিকাল ৪টায় স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক ও সহযোগী পরিচালক ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন জানান, সকাল থেকে খাদিজাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ২টা পর্যন্ত তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ২টার পর তার অস্ত্রোপচার শুরু হয়। তার মাথায় অনেক কোপানোর চিহ্ন রয়েছে। তাকে এমনভাবে কোপানো হয়েছে যে মাথার খুলি ভেদ করে ব্রেন ইনজুরি হয়েছে। মেয়েটি হয়তো দুই হাত দিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছিল। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার হাতও ইনজুরি হয়েছে। হাত ও মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। নার্গিসের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে এই চিকিৎসক জানান, তার অবস্থা খুবই খারাপ। বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। তার পরও তাকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সন্ধ্যায় অস্ত্রোপচার শেষে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় খাদিজাকে। নার্গিসকে স্কয়ার হাসপাতালের পঞ্চম তলায় ওটিতে যখন অস্ত্রোপচার করা হচ্ছিল তখন তার চাচা আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে কথা হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবদুল কুদ্দুস জানান, প্রবাসী পিতার একমাত্র মেয়ে খাদিজা আক্তার নার্গিস। কখনও তাকে একা কলেজে যেতে দিতেন না তারা। প্রতিদিন নিজেদের সিএনজি অটোরিকশাযোগে নার্গিসকে কলেজে আনা-নেয়া করতেন আবদুল কুদ্দুস। বোরকা পরেই কলেজে যেতেন নার্গিস। নার্গিসের চাচা আবদুল কুদ্দুস বলেন, আমি তখনও কিছুই জানতাম না। কলেজের গেটের সামনে অপেক্ষা করছিলাম। নার্গিস বের হলে তাকে নিয়ে বাড়ি যাব। ঠিক তখনই তার এক বান্ধবী ফোনে জানায় নার্গিসকে একটি ছেলে কুপিয়ে আহত করেছে। তাকে নিয়ে ওসমানী মেডিকেলে যাচ্ছে তারা। তারপর আবদুল কুদ্দুসও ছুটে যান সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত ১২টার দিকে হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, নার্গিসের অবস্থা গুরুতর। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানোর দরকার। আবদুল কুদ্দুস বলেন, নার্গিসের পিতা মাসুক আহমদ দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত সৌদি আরবের জেদ্দায় থাকেন। তার তিন ছেলে ও একমাত্র মেয়ে নার্গিস। বড় ছেলে চীনে লেখাপড়া করে। মেজো ছেলে সিলেটের সেন্ট্রাল কলেজে ও ছোট ছেলে মাদরাসায় লেখাপড়া করে। ছেলেমেয়ের মধ্যে নার্গিস দ্বিতীয়। সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করেন মাসুক। তার মেয়ে আহত হয়েছে খবর পেয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। আবদুল কুদ্দুস বলেন, কি অপরাধ ছিল আমার ভাতিজির। কেন তাকে এভাবে কুপিয়ে আহত করা হলো। মেয়েকে কি এজন্য বড় করেছিলাম! একটা সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে একটি কলেজের ক্যাম্পাসে আমাদের মেয়েকে কোপালো।
খাদিজার পুরো নাম খাদিজা আক্তার নার্গিস। বাড়ি সিলেট শহরতলির আউশা গ্রামে। তিনি সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা থাকায় এমসি কলেজ গিয়েছিলেন তিনি। খাদিজার ওপর হামলাকারী বদরুল বাড়ি ছাতক উপজেলায়। সে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদকও। টুকেরবাজার এলাকার একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতো। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগে বদরুল আলম আউশা গ্রামের খাদিজাদের বাড়িতে লজিং থাকতো। ওই সময় খাদিজা তার ছাত্রী ছিল। কিন্তু বদরুল খাদিজাকে প্রায়ই প্রেমের প্রস্তাব দিতো। এতে সাড়া দেননি খাদিজা। বিষয়টি তিনি জানান পরিবারকে। পরবর্তীতে বদরুলকে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর বদরুল টুকেরবাজার এলাকায় বসবাস করছিল। খাদিজার প্রতি তার নজর ছিল। কলেজে যাওয়ার আসার পথে প্রায়ই বদরুল খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করতো। খাদিজার কয়েকজন বান্ধবী জানিয়েছেন, সোমবার পরীক্ষা শেষ করে যখন তারা হেঁটে পুকুরপাড়ে আসেন তখন মূল ফটক এলাকা দিয়ে আসছিল বদরুলও। সে এসে খাদিজার মুখোমুখি দাঁড়ায়। বিষয়টি ব্যক্তিগত বলে সহপাঠীরা একটু এগিয়ে যান। এমন সময় তারা দেখেন বদরুল খাদিজাকে কয়েকটি চড় মারে। এরপর সে কোমরের পেছন থেকে চাপাতি বের করে মাথায় কোপ দেয়। এ সময় বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করে খাদিজা। দৌড়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা চালায়। কিন্তু অল্প দূরে গিয়েই মাটিতে লুটে পড়েন। আর ওই সময় কালো বোরকা পরা খাদিজাকে মাটিতে ফেলে নির্মমভাবে কোপাতে থাকে বদরুল। এ কোপানোর দৃশ্য দেখে ছাত্রীরা চিৎকার করে দৌড়াতে থাকেন। এক সময় খাদিজার দেহ নিথর হয়ে পড়লে বদরুল পুকুরের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে পালানো চেষ্টা করে। এ সময় হাতে থাকা চাপাতিও ছুড়ে ফেলে পুকুরের পাশে। আর চাপাতি ফেলে দেয়ার পরপরই ক্যাম্পাসে থাকা ছাত্ররা ধাওয়া করে তাকে আটক করে পুলিশে দেয়। আর রক্তাক্ত খাদিজাকে নিয়ে আসা হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাতে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার প্রায় ৪ ঘণ্টা অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় রাতেই তাকে ঢাকায় স্থানান্তরের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এদিকে, রাতেই পুলিশ আহত অবস্থায় বদরুলকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে হাতকড়া পরানো অবস্থায় পুলিশি প্রহরায় চিকিৎসা দেয়া হয়। এদিকে, গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই খাদিজার ওপর হামলার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে সিলেট। সকাল ১০টায় একে একে শিক্ষার্থীরা সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে এসে এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শিক্ষকরাও হন তাদের সঙ্গে যুক্ত। বেলা ১১টায় তারা কলেজের মূল ফটকের বাইরের রাস্তায় মানববন্ধন শুরু করেন। হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে হামলাকারীর শাস্তির দাবিতে তারা মানববন্ধন শুরু করেন। মানববন্ধনে উপস্থিত অনেক ছাত্রীই এ সময় সহপাঠীর জন্য কান্নায় ভেঙে পড়েন। কয়েকশ’ ছাত্রী আম্বরখানা-বন্দরবাজার সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা জানান, হামলাকারীর শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর ড. নুরুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক মছব্বির চৌধুরী ও মানিক কুমার সাহা। প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ, বিক্ষোভ চলার পর ১২টার দিকে প্রিন্সিপালসহ শিক্ষকরা ছাত্রীদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেন। এদিকে, ক্যাম্পাসে ফিরে শিক্ষার্থীরা ৩ দফা দাবি তুলে ধরে আলটিমেটাম দিয়েছেন। দাবিগুলো হচ্ছে- খাদিজার ওপর হামলার ঘটনার দ্রুত বিচার করা, হামলাকারীর শাস্তি নিশ্চিত করা, আর কোনো শিক্ষার্থীর ওপর যাতে হামলা না হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ সময় তারা ঘোষণা দেন, বুধবার থেকে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের সব শিক্ষার্থী ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করবেন। এ সময় তারা শিক্ষকদেরও কর্মসূচিতে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি কালোব্যাজ ধারণ, বিক্ষোভ কর্মসূচিসহ তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা দেন। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের সামনে যখন বিক্ষোভ চলছিল তখন এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয় সিলেট-তামাবিল সড়কে। তারা ওই সড়ক অবরোধকালে ৫-৬টি যানবাহনের গ্লাস ভাঙচুর করে। ফলে এমসির ফটকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এমসির শিক্ষার্থীরা অবরোধ পালনকালে জানিয়েছেন, খাদিজার ওপর হামলা চলাকালে ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন ছিল। কিন্তু ঘটনার ১০ মিনিট পর পুলিশ সেখানে যায়। আরো আগে পুলিশ সেখানে গেলে হয়তো খাদিজার ওপর এতো অত্যাচার চালাতে পারতো না বদরুল। দুপুর ১২টার দিকে এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে ফিরে যায়। এদিকে, এ ঘটনায় গতকাল দুপুরে খাদিজার চাচা আব্দুল কুদ্দুস বাড়ি হয়ে সিলেটের শাহপরাণ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে বদরুল আলমকে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ অংশের উপ-পুলিশ কমিশনার বাসুদেব বণিক জানিয়েছেন, মর্মান্তিক এ ঘটনায় যাতে অপরাধীর সাজা হয় সে ব্যাপারে পুলিশ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইতিমধ্যে পুলিশ এ ঘটনায় তদন্ত শুরু করে দিয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, এ ঘটনায় সবাই মর্মাহত। তবে, আশার কথা হলো ছাত্রদের সহায়তায় পুলিশ হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের দাবি: দুপুরে নার্গিসকে দেখতে স্কয়ার হাসপাতালে যান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন। তিনি বলেন, নার্গিসের চিকিৎসার ব্যাপারে যা করা প্রয়োজন আমরা তাই করবো। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। হামলাকারী সম্পর্কে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, কারো মধ্যে যদি পশুত্ববোধ জেগে ওঠে তাহলে ছাত্রলীগ কী করবে। কারো ব্যক্তিগত অপরাধের দায় ছাত্রলীগ নেবে না। অভিযুক্ত বদরুল আলম এখন ছাত্রলীগের কেউ নয় জানিয়ে তিনি বলেন, অভিযুক্ত বদরুল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিল। সে ছাতকের আলহাজ আয়েজুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে চাকরি করতো। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেউ যদি চাকরি করে অথবা বিয়ে করে তাহলে সে ছাত্রলীগের ওই পদে আর থাকবে না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তার পদ এমনিই বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং সে এখন ছাত্রলীগের কেউ না।
এদিকে দিনভর খাদিজাকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়েছেন চিকিৎসকরা। বিকাল ৪টায় স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক ও সহযোগী পরিচালক ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন জানান, সকাল থেকে খাদিজাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ২টা পর্যন্ত তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ২টার পর তার অস্ত্রোপচার শুরু হয়। তার মাথায় অনেক কোপানোর চিহ্ন রয়েছে। তাকে এমনভাবে কোপানো হয়েছে যে মাথার খুলি ভেদ করে ব্রেন ইনজুরি হয়েছে। মেয়েটি হয়তো দুই হাত দিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছিল। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার হাতও ইনজুরি হয়েছে। হাত ও মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। নার্গিসের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে এই চিকিৎসক জানান, তার অবস্থা খুবই খারাপ। বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। তার পরও তাকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সন্ধ্যায় অস্ত্রোপচার শেষে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় খাদিজাকে। নার্গিসকে স্কয়ার হাসপাতালের পঞ্চম তলায় ওটিতে যখন অস্ত্রোপচার করা হচ্ছিল তখন তার চাচা আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে কথা হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবদুল কুদ্দুস জানান, প্রবাসী পিতার একমাত্র মেয়ে খাদিজা আক্তার নার্গিস। কখনও তাকে একা কলেজে যেতে দিতেন না তারা। প্রতিদিন নিজেদের সিএনজি অটোরিকশাযোগে নার্গিসকে কলেজে আনা-নেয়া করতেন আবদুল কুদ্দুস। বোরকা পরেই কলেজে যেতেন নার্গিস। নার্গিসের চাচা আবদুল কুদ্দুস বলেন, আমি তখনও কিছুই জানতাম না। কলেজের গেটের সামনে অপেক্ষা করছিলাম। নার্গিস বের হলে তাকে নিয়ে বাড়ি যাব। ঠিক তখনই তার এক বান্ধবী ফোনে জানায় নার্গিসকে একটি ছেলে কুপিয়ে আহত করেছে। তাকে নিয়ে ওসমানী মেডিকেলে যাচ্ছে তারা। তারপর আবদুল কুদ্দুসও ছুটে যান সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত ১২টার দিকে হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, নার্গিসের অবস্থা গুরুতর। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানোর দরকার। আবদুল কুদ্দুস বলেন, নার্গিসের পিতা মাসুক আহমদ দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত সৌদি আরবের জেদ্দায় থাকেন। তার তিন ছেলে ও একমাত্র মেয়ে নার্গিস। বড় ছেলে চীনে লেখাপড়া করে। মেজো ছেলে সিলেটের সেন্ট্রাল কলেজে ও ছোট ছেলে মাদরাসায় লেখাপড়া করে। ছেলেমেয়ের মধ্যে নার্গিস দ্বিতীয়। সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করেন মাসুক। তার মেয়ে আহত হয়েছে খবর পেয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। আবদুল কুদ্দুস বলেন, কি অপরাধ ছিল আমার ভাতিজির। কেন তাকে এভাবে কুপিয়ে আহত করা হলো। মেয়েকে কি এজন্য বড় করেছিলাম! একটা সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে একটি কলেজের ক্যাম্পাসে আমাদের মেয়েকে কোপালো।
খাদিজার পুরো নাম খাদিজা আক্তার নার্গিস। বাড়ি সিলেট শহরতলির আউশা গ্রামে। তিনি সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা থাকায় এমসি কলেজ গিয়েছিলেন তিনি। খাদিজার ওপর হামলাকারী বদরুল বাড়ি ছাতক উপজেলায়। সে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদকও। টুকেরবাজার এলাকার একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতো। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগে বদরুল আলম আউশা গ্রামের খাদিজাদের বাড়িতে লজিং থাকতো। ওই সময় খাদিজা তার ছাত্রী ছিল। কিন্তু বদরুল খাদিজাকে প্রায়ই প্রেমের প্রস্তাব দিতো। এতে সাড়া দেননি খাদিজা। বিষয়টি তিনি জানান পরিবারকে। পরবর্তীতে বদরুলকে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর বদরুল টুকেরবাজার এলাকায় বসবাস করছিল। খাদিজার প্রতি তার নজর ছিল। কলেজে যাওয়ার আসার পথে প্রায়ই বদরুল খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করতো। খাদিজার কয়েকজন বান্ধবী জানিয়েছেন, সোমবার পরীক্ষা শেষ করে যখন তারা হেঁটে পুকুরপাড়ে আসেন তখন মূল ফটক এলাকা দিয়ে আসছিল বদরুলও। সে এসে খাদিজার মুখোমুখি দাঁড়ায়। বিষয়টি ব্যক্তিগত বলে সহপাঠীরা একটু এগিয়ে যান। এমন সময় তারা দেখেন বদরুল খাদিজাকে কয়েকটি চড় মারে। এরপর সে কোমরের পেছন থেকে চাপাতি বের করে মাথায় কোপ দেয়। এ সময় বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করে খাদিজা। দৌড়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা চালায়। কিন্তু অল্প দূরে গিয়েই মাটিতে লুটে পড়েন। আর ওই সময় কালো বোরকা পরা খাদিজাকে মাটিতে ফেলে নির্মমভাবে কোপাতে থাকে বদরুল। এ কোপানোর দৃশ্য দেখে ছাত্রীরা চিৎকার করে দৌড়াতে থাকেন। এক সময় খাদিজার দেহ নিথর হয়ে পড়লে বদরুল পুকুরের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে পালানো চেষ্টা করে। এ সময় হাতে থাকা চাপাতিও ছুড়ে ফেলে পুকুরের পাশে। আর চাপাতি ফেলে দেয়ার পরপরই ক্যাম্পাসে থাকা ছাত্ররা ধাওয়া করে তাকে আটক করে পুলিশে দেয়। আর রক্তাক্ত খাদিজাকে নিয়ে আসা হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাতে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার প্রায় ৪ ঘণ্টা অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় রাতেই তাকে ঢাকায় স্থানান্তরের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এদিকে, রাতেই পুলিশ আহত অবস্থায় বদরুলকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে হাতকড়া পরানো অবস্থায় পুলিশি প্রহরায় চিকিৎসা দেয়া হয়। এদিকে, গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই খাদিজার ওপর হামলার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে সিলেট। সকাল ১০টায় একে একে শিক্ষার্থীরা সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে এসে এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শিক্ষকরাও হন তাদের সঙ্গে যুক্ত। বেলা ১১টায় তারা কলেজের মূল ফটকের বাইরের রাস্তায় মানববন্ধন শুরু করেন। হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে হামলাকারীর শাস্তির দাবিতে তারা মানববন্ধন শুরু করেন। মানববন্ধনে উপস্থিত অনেক ছাত্রীই এ সময় সহপাঠীর জন্য কান্নায় ভেঙে পড়েন। কয়েকশ’ ছাত্রী আম্বরখানা-বন্দরবাজার সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা জানান, হামলাকারীর শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর ড. নুরুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক মছব্বির চৌধুরী ও মানিক কুমার সাহা। প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ, বিক্ষোভ চলার পর ১২টার দিকে প্রিন্সিপালসহ শিক্ষকরা ছাত্রীদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেন। এদিকে, ক্যাম্পাসে ফিরে শিক্ষার্থীরা ৩ দফা দাবি তুলে ধরে আলটিমেটাম দিয়েছেন। দাবিগুলো হচ্ছে- খাদিজার ওপর হামলার ঘটনার দ্রুত বিচার করা, হামলাকারীর শাস্তি নিশ্চিত করা, আর কোনো শিক্ষার্থীর ওপর যাতে হামলা না হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ সময় তারা ঘোষণা দেন, বুধবার থেকে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের সব শিক্ষার্থী ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করবেন। এ সময় তারা শিক্ষকদেরও কর্মসূচিতে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি কালোব্যাজ ধারণ, বিক্ষোভ কর্মসূচিসহ তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা দেন। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের সামনে যখন বিক্ষোভ চলছিল তখন এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয় সিলেট-তামাবিল সড়কে। তারা ওই সড়ক অবরোধকালে ৫-৬টি যানবাহনের গ্লাস ভাঙচুর করে। ফলে এমসির ফটকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এমসির শিক্ষার্থীরা অবরোধ পালনকালে জানিয়েছেন, খাদিজার ওপর হামলা চলাকালে ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন ছিল। কিন্তু ঘটনার ১০ মিনিট পর পুলিশ সেখানে যায়। আরো আগে পুলিশ সেখানে গেলে হয়তো খাদিজার ওপর এতো অত্যাচার চালাতে পারতো না বদরুল। দুপুর ১২টার দিকে এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে ফিরে যায়। এদিকে, এ ঘটনায় গতকাল দুপুরে খাদিজার চাচা আব্দুল কুদ্দুস বাড়ি হয়ে সিলেটের শাহপরাণ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে বদরুল আলমকে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ অংশের উপ-পুলিশ কমিশনার বাসুদেব বণিক জানিয়েছেন, মর্মান্তিক এ ঘটনায় যাতে অপরাধীর সাজা হয় সে ব্যাপারে পুলিশ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইতিমধ্যে পুলিশ এ ঘটনায় তদন্ত শুরু করে দিয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, এ ঘটনায় সবাই মর্মাহত। তবে, আশার কথা হলো ছাত্রদের সহায়তায় পুলিশ হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের দাবি: দুপুরে নার্গিসকে দেখতে স্কয়ার হাসপাতালে যান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন। তিনি বলেন, নার্গিসের চিকিৎসার ব্যাপারে যা করা প্রয়োজন আমরা তাই করবো। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। হামলাকারী সম্পর্কে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, কারো মধ্যে যদি পশুত্ববোধ জেগে ওঠে তাহলে ছাত্রলীগ কী করবে। কারো ব্যক্তিগত অপরাধের দায় ছাত্রলীগ নেবে না। অভিযুক্ত বদরুল আলম এখন ছাত্রলীগের কেউ নয় জানিয়ে তিনি বলেন, অভিযুক্ত বদরুল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিল। সে ছাতকের আলহাজ আয়েজুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে চাকরি করতো। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেউ যদি চাকরি করে অথবা বিয়ে করে তাহলে সে ছাত্রলীগের ওই পদে আর থাকবে না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তার পদ এমনিই বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং সে এখন ছাত্রলীগের কেউ না।