কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, শি জিনপিংয়ের সফরের সময় বাংলাদেশের ২৫টি প্রকল্পে প্রায় ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকার অর্থায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা আসতে পারে। এ সফরের সময় প্রায় ২০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও চুক্তি সইয়ের প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, শিল্প উৎপাদন-বিষয়ক রূপরেখা চুক্তি এবং বিনিয়োগ ও উৎপাদন-বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শি জিনপিংয়ের সফরের সময় যেসব এমওইউ সইয়ের প্রস্তুতি চলছে, তার মধ্যে অর্ধেক প্রকল্প-সংক্রান্ত এবং বাকিগুলো নীতিবিষয়ক। তবে এবার সম্ভাব্য সইয়ের তালিকায় থাকা এমওইউর মধ্যে প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত কিছু নেই। দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে চীনের সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্য-বৈষম্য কমাতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া চীনের ঋণের সুদের হার ২ শতাংশ থেকে দেড় শতাংশে নামিয়ে আনার বিষয়টি তুলবে বাংলাদেশ।
চীন এবারের সফরের সময় অর্থনীতিসহ সহযোগিতার অনেকগুলো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আগ্রহী থাকলেও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ কিছুটা ধীরে এগোতে চায়। এ জন্য গঙ্গা ব্যারাজের মতো কৌশলগত তাৎপর্য আছে, এমন প্রকল্পে এখনই সহায়তা নেবে না। তবে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কনসোর্টিয়ামে চীনকে যুক্ত করা ও সামুদ্রিক অর্থনীতিতে সহযোগিতার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে সমঝোতা স্মারক সই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে শি জিনপিংয়ের সফরে বাংলাদেশের যে ২৫ প্রকল্পে অর্থায়নের ঘোষণা আসবে, তা চূড়ান্ত করতে গতকাল বৃহস্পতিবার চীনের এক্সিম ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষ করেছে। এই সফরে যে প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নের চূড়ান্ত ঘোষণা আসবে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ, সীতাকুণ্ড-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও উপকূলীয় সুরক্ষা, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ, মোংলা বন্দর সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ও আখাউড়া-সিলেট রেললাইন মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর, বড়পুকুরিয়ায় ভূগর্ভস্থ কয়লা উত্তোলন প্রকল্পের ধারণক্ষমতার সম্প্রসারণ, গজারিয়ায় ৩৫০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামো নির্মাণের তৃতীয় ধাপ।
জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ তিন দশক পর চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। এই সফরের প্রভাবও হবে সুদূরপ্রসারী। ভৌগোলিক কারণে চীনের কাছে বাংলাদেশের বিশেষ গুরুত্ব আছে। কাজেই অর্থনৈতিক যে সহযোগিতা ভবিষ্যতে হবে, তার আর্থিক দিকের পাশাপাশি কৌশলগত দিকও থাকবে। কাজেই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগের সদ্ব্যবহারের পাশাপাশি ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারেও বাংলাদেশের মনোযোগী হওয়া উচিত।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর সংক্ষিপ্ত হলেও কয়েকটি কারণে বাংলাদেশের জন্য তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের এগিয়ে যাওয়ার রাশ টেনে ধরতে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশকে নিয়ে সক্রিয় রয়েছে। অন্যদিকে শি জিনপিং তাঁর ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’, ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’সহ বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে তাঁর দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা নেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন। তেমনি সাগর ও সড়কপথে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে তাঁর দেশের সংযোগ বাড়াতে মনোযোগী রয়েছেন তিনি। এসবের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিবলয় তৈরি করে চীনের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করছে জেনে শি জিনপিংও অর্থনীতিসহ নানা রকম সুবিধা দিয়ে তাঁর দেশের বন্ধুর তালিকা দীর্ঘ করতে সচেষ্ট আছেন। বিশেষ করে, তাঁর ঢাকা সফরে প্রায় ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকার ২৫টি প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা এটি প্রমাণ করে। দ্বিতীয়ত, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে চীন। এ অঞ্চলকে ঘিরে ‘স্ট্রিং অফ পার্ল’, অর্থাৎ চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সংযোগ স্থাপনের প্রয়াসটি শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ব্যাহত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে যুক্ত হয়ে এই ধাক্কা সামলে নিতে আগ্রহী চীন। তাই শেষ পর্যন্ত এককভাবে না হলেও কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে বন্দর নির্মাণের প্রক্রিয়ায় চীন যুক্ত থাকতে চাইছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই বছর আগের সময়টাকে চীন বিবেচনায় নিচ্ছে।
জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ইমতিয়াজ আহমেদ কলম্বো থেকে প্রথম আলোকে বলেন, তিন দশক আগের চীন আর ২০১৬ সালের চীন এক নয়। বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিচিত দেশটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার পথে এগোচ্ছে। শি জিনপিংয়ের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগে বাংলাদেশও আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সীমান্তের দূরত্ব যেখানে মাত্র ৯০ মাইলের, তাই দেশটিকে আমাদের ‘প্রায় প্রতিবেশী’ই বিবেচনা করা যায়। আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন মানে যে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি নয়, এটি বাংলাদেশের অন্য দেশগুলোকে বোঝাতে হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলাদেশের সুযোগ ও সম্ভাবনা বাড়বে।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের জুনে শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের সময় দুই দেশ ‘সহযোগিতার জন্য নিবিড় সমন্বিত অংশীদারত্ব’ প্রতিষ্ঠায় রাজি হয়। ওই বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মে মাসে জাপান ও জুনে চীন সফর করেন শেখ হাসিনা। সেপ্টেম্বরে ঢাকায় ফিরতি সফরে আসেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। শেখ হাসিনার সঙ্গে শিনজো আবের বৈঠকে সম্পর্ককে ‘সমন্বিত অংশীদারত্বের’ পর্যায়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত হয়।